শিরোনাম |
❒ যশোর জেনারেল হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবায় নৈরাজ্য কোনভাবেই থামছে না
যশোর স্বাস্থ্য বিভাগের নৈরাজ্য কোনভাবেই থামছে না। সরকারি চাকরি করেও জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তাররা শহরের এক একটি ক্লিনিকের ঠিকাদারী নিয়ে বসে রয়েছেন। তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন হাসপাতালে আসা রোগীরা। ডাক্তাররা রীতিমত ক্লিনিকের কার্ড রোগীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেখানে ভর্তি হবার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন জেনারেল হাসপাতালে অপারেশন করতে হলে সিরিয়ালে পড়ে বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে, এতে তার ক্ষতি হবে।
ভয়ে ও আতঙ্কে রোগীরা ডাক্তারের পরামর্শে ওইসব ক্লিনিকে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। যশোর জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগে গরীব রোগীদের ‘ভুল বুঝিয়ে’ এ জাতীয় অনৈতিক কারবার প্রতিদিনই ঘটে চলেছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
যশোর জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে গত সোম ও মঙ্গলবার (৭ ও ৮ এপ্রিল) বহির্বিভাগ এবং জরুরি বিভাগে দেখা যায় নানা অনিয়মের চিত্র। এ দু’দিন সকাল ১০টার পর থেকে বহির্বিভাগে ছিল রোগীদের ব্যাপক ভিড়। এসব রোগীদের ৮০ ভাগই ছিল গরীব ও গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা। তারা হাসপাতালে চিকিৎসা বিষয়ক দশ টাকা মূল্যের টিকিট কেটে নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। যদিও রোগীদের অভিযোগ, তারা ডাক্তারদের কাছ থেকে যথাযথভাবে চিকিৎসাসেবা পাননি। ডাক্তাররা রোগের উপসর্গ কোনভাবে শুনেই প্রেসক্রিপশন করে ছেড়ে দিয়েছেন। এ কাজে রোগীর কথা শোনার মত তাদের সময় নেই বলে বেশ কয়েকজন নারী রোগী অভিযোগ করেন।
এদিকে, যশোর জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে নানা অনৈতিকতার দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। নিয়মানুযায়ী বহির্বিভাগের ডাক্তারদের সকাল ৮টায় হাসপাতালে তাদের চেম্বারে গিয়ে রোগী দেখার কথা। কিন্তু এসময়ে তাদের কাউকে দেখা পাওয়া যায় না। সকাল ৯টার পর তারা চেম্বারে আসতে শুরু করেন। তারপরও তারা রোগী দেখেন না। জুনিয়র ইন্টার্নি ডাক্তার দিয়ে তারা রোগী দেখার কাজ সেরে ফেলেন। এসময়ে তারা চলে যান তাদের নির্দিষ্ট ক্লিনিকগুলোতে। দুপুর ২টা পর্যন্ত বহির্বিভাগে তাদের রোগী দেখার কথা থাকলেও সাড়ে ১২টার পর চেম্বর শূন্য হয়ে যায়। এছাড়া, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সপ্তাহে দু’দিন বহির্বিভাগে রোগী দেখার নিয়ম থাকলেও তাদের দেখা পাওয়া যায় না। সেখানেও তারা জুনিয়র ডাক্তার দিয়ে কাজ সেরে ফেলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একইসাথে হাসপাতালের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে ক্লিনিকে রোগী ভাগিয়ে নেয়ার। যে কাজটি আগে করতো ক্লিনিকগুলোর নিয়োগকৃত দালালরা। কিন্তু এখন সরাসরি এ কাজে ডাক্তাররা নেমে পড়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে তারা একটু ভিন্ন স্টাইল নিয়েছেন। তারা হাসপাতালে আগত অসহায় দরিদ্র রোগীদের গিনিপিগ বানাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, যশোর হাসপাতালে কর্মরত বেশির ভাগ ডাক্তারই শহরের কোন না কোন ক্লিনিকের ব্যবসার সাথে জড়িত। এ কারণে তাদের ব্যবসার প্রসারের জন্য বা নিজের বাড়তি আয়ের কারণে হাসপাতালে আগত রোগীদের নানা মিথ্যা প্রলোভনে ক্লিনিকে যাবার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে আশ^াস দেয়া হয়, কম খরচে তাদেরকে ভালো চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে। প্রতিদিনই হাসপাতালে আসা রোগীরা ডাক্তারদের এ জাতীয় খপ্পরে পড়ছে। আর এতে লাভবান হচ্ছেন ডাক্তার ও ক্লিনিক মালিকরা এবং ক্ষতির শিকার হচ্ছেন গ্রাম থেকে আসা নিরীহ গরীব রোগীরা।
মঙ্গলবার সকালে শহরের বারান্দি মোল্লাপাড়া এলাকার তামিমকে (১২) তার অভিভাবকরা যশোর জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যান। তার হাতে একটি ফোঁড়ার (জামরো) মত উঠেছে। এসময় তারা বহির্বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তার কানিজ ফাতেমা অ্যানির কাছে গেলে তিনি রোগী দেখে বলেন, তার হাতের অপারেশন করে ফোঁড়া কেটে ফেলতে হবে। নতুবা তার হাতের সমস্যা বড় আকার ধারণ করবে। এসময় তিনি বলেন, এ অপারেশন হাসপাতালে ভালো হবে না। ভালো চিকিৎসা নিতে হলে তার ইউনিক হাসপাতালে যেতে হবে। এসময় রোগীর হাতে ক্লিনিকের ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলেন, কোন সমস্য হবে না, তিনি ক্লিনিকের সাথে জড়িত। কম টাকায় ভালোভাবে তিনি অপারেশন করিয়ে দেবেন। এরপর তিনি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাইরে এসে টাকার চিন্তায় অস্থির হয়ে নানা মানুষের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে থাকেন। এসময় অনেকেই মন্তব্য করেন হাসপাতালেই সামান্য এ অপারেশন করা সম্ভব। এর জন্য কোন ক্লিনিকে যাবার প্রয়োজন নেই। এক পর্যায়ে তামিমকে নিয়ে তার অভিভাবকরা বাড়ি ফিরে যান।
এ বিষয়ে জানার জন্য কয়েক দফা ডাক্তার কানিজ ফাতেমা অ্যানির মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। এ কারণে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এ জাতীয় ঘটনা প্রতিদিনই যশোর হাসপাতালের বহির্বিভাগে ঘটছে। কিন্তু প্রতিকারের কোন উপায় নেই। সোমবার একই ঘটনার শিকার হয়েছেন শহরের খড়কি এলাকার শিক্ষার্থী তামান্না। এদিন কানের সমস্যা নিয়ে তিনি হাসপাতালে যান। ডাক্তার দেখানোর পর তাকে জানানো হয়, কানে সমস্যা আছে, তাকে ওয়াশসহ ছোট্ট অপারেশন করতে হবে। যেটা হাসপাতালে সম্ভব নয়। এ কারণে তাকে ক্লিনিকে যেতে হবে। তাকে হাসপাতালের নাক-কান বিভাগে ডাক্তার গেটের সামনের একটি ক্লিনিকে যাবার পরামর্শ দেন। সেখানে ভর্তি হলে তিনি থেকেই সব ব্যবস্থা করে দেবেন বলে জানান। ডাক্তারদের এ জাতীয় হীন মানষিকতার কারণে অসুস্থ গরীব রোগীরা বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গিয়ে উল্টো খরচের শিকার হচ্ছেন, নতুবা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রোগীদের।
এসব বিষয়ে কথা হয় যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার হুসাইন শাফায়াতের সাথে। তিনি বলেন, হাসপাতালে তিনি অল্প কয়েকদিন দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি এসব বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, কিছু সমস্যা হচ্ছে। সেসব বিষয়ে তিনি ইতিমধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন এবং করণীয় সমাধানে আরো কি করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আগামীতে রোগীরা হাসপাতাল থেকেই সহজে সব সেবা পাবেন। কোন অনিয়ম ও দুর্নীতিকে তিনি প্রশ্রয় দেবেন না বলে জানান।