শিরোনাম |
‘‘আমরা হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবে ভাবছি—‘নদী তো মরেই!’ কিন্তু কেউ ভাবছি না, নদী মরলে প্রকৃতপক্ষে আমাদের অস্তিত্বই সংকটে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি কিংবা খরার প্রকোপ—সব কিছু আরও বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে এই মৃত নদী।’’
একটা সময় ছিল, যখন বুড়িভদ্রা ছিল প্রাণবন্ত, খরস্রোতা নদী। স্রোতের শব্দে চারপাশ মুখরিত থাকত, নদীর কূলে কূলে কৃষকের স্বপ্ন ভেসে বেড়াত, কিশোররা মাছ ধরার ছিপ-জাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত তীরে। আজ সেই নদী মৃতপ্রায়। কেশবপুরের মঙ্গলকোট অঞ্চলে বুড়িভদ্রা নদীর এই করুণ পরিণতি চোখে দেখা যায় — পানি নেই, স্রোত নেই, প্রাণ নেই।
শুধু স্মৃতির পাতায় বেঁচে আছে কিশোর বেলার সেই দীর্ঘ বাঁশের সাঁকো পারাপারের গল্প। এখন শুকনো নদীর বুকে কিশোররা মাছ ধরার জন্য বাঁধ দেয়। প্রকৃতির এক নীরব মৃত্যু আমরা অবলীলায় প্রত্যক্ষ করছি, অথচ তাতে আমাদের মন ভারী হয় না।
নদীর নাব্যতা হারানোর এই চিত্র কেবল বুড়িভদ্রার গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের অধিকাংশ ছোট-বড় নদীর বাস্তবতা। নদী মরলে বর্ষায় জলাবদ্ধতা বাড়ে, কৃষি জমিতে পানি জমে থাকে, মানুষের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। কেশবপুরের মঙ্গলকোট, গোলদারপাড়া অঞ্চলের মানুষ প্রতিবছর এই জলাবদ্ধতার কাছে হার মানে।
অথচ এক সময় এই নদীই ছিল জীবন-জীবিকার প্রধান ভরসা। কৃষক, জেলে, মাঝি, ব্যবসায়ী— সবাই এই নদীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। সময়ের সাথে সাথে মানুষের স্বার্থপর পরিকল্পনা, অপরিকল্পিত বাঁধ, দখল, দুষণ এবং কর্তৃত্বের লোভ বুড়িভদ্রার বুক চিরে তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
একদিকে নদীর বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ভূমি খেকোদের লোভ বাড়ছে। পলি জমে যখন নদী সংকুচিত হয়, তখন দখলবাজেরা ওই স্থানকে ‘নিজস্ব জমি’ ভেবে দখলে নিচ্ছে। নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ হচ্ছে। অথচ এটি পরিবেশের জন্য ধ্বংসাত্মক, কৃষির জন্য ক্ষতিকর এবং জনজীবনের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে।
নদী শুধু পানি প্রবাহের নাম নয়, এটি একটি প্রাণব্যবস্থার কেন্দ্র। মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ, কৃষি, পরিবেশ — সবই নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠে। নদীর মৃত্যু মানে জীববৈচিত্র্যের মৃত্যু। তারও ভয়ংকর পরিণতি হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রায়।
আমরা হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবে ভাবছি—‘নদী তো মরেই!’ কিন্তু কেউ ভাবছি না, নদী মরলে প্রকৃতপক্ষে আমাদের অস্তিত্বই সংকটে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি কিংবা খরার প্রকোপ—সব কিছু আরও বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে এই মৃত নদী।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতির সমাধান কী?
প্রথমত, বুড়িভদ্রাসহ দেশের অন্যান্য নদীর জন্য জরুরি খনন কর্মসূচি শুরু করা প্রয়োজন। শুধু খনন করলেই চলবে না, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখার জন্য দখলদারদের উচ্ছেদ এবং বাঁধ অপসারণ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক শক্ত ভূমিকা দরকার। নদী রক্ষা কমিশনকে আরও কার্যকর করতে হবে, দখলবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। জনগণের সচেতনতা বাড়ানো দরকার — নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
বুড়িভদ্রার এই দুঃখগাথা আজ একটি অঞ্চলের নয়, বরং সমগ্র দেশের জন্য এক শোকসংবাদ। সময় থাকতে এই সংকটের সমাধানে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার। নদী আমাদের শিকড়, সেই শিকড় কেটে আমরা বেঁচে থাকতে পারব না।
লেখক: কলামিস্ট ও গণসংযোগবিদ
bbqif1983@gmail.com