gramerkagoj
বুধবার ● ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩ মাঘ ১৪৩১
gramerkagoj
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)
এক প্রজন্মের একাল সেকাল (শেষ পর্ব)
প্রকাশ : মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর , ২০২৪, ০৮:৫৯:০০ পিএম
মাহমুদা রিনি:
GK_2024-12-31_677406da2824b.jpg

গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে আনন্দের সময় হতো অঘ্রাণের শুরুতে যখন নতুন ধান কৃষকের ঘরে আসে। উঠোন ভর্তি ধান, কিষাণ- কিষাণীর নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। এখনকার মতো বোরোধানের আবাদ তখন হয়নি। আউশধান উঠতো ভাদ্রমাসে। চাহিদার তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল। কোনোমতে প্রয়োজন মিটতো কিছু সময়ের। তাই অঘ্রাণে আমনধান উঠলে এক নতুন আনন্দে মুখরিত হতো কৃষকের আঙিনা। সারাবছরের ধারদেনা শোধ করে বছরের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন এসময় মিটিয়ে নিত। চিড়ামুড়ি, চালের গুড়ো, ডালের বড়ি, পিঠাপুলি তৈরির কাজে গৃহিণীদের তখন ব্যস্ত সময়। ধান বিক্রি করে পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হতো। অনেক সময় গৃহিণীরা ধানের বদলে ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে মাটির হাঁড়ি পাতিল, বাঁশের কুলো- ডালা সহ সংসারের খুটিনাটি জিনিসপত্র কিনতো। বাজার থেকে পরনের কাপড়, বিশেষ করে গৃহিণীর সারাবছরের জন্য দুটো শাড়িও তখন কেনা হতো। এখনকার মানুষ বুঝতে পারবে না মোটা তাঁতের দুটো শাড়িতে তাদের বছর চলে যেত। এমনকি মেয়েদের সায়া-ব্লাউজ পরার চলও সব বাড়িতে ছিল না। এত অল্প চাহিদায়ও মানুষের মুখে হাসি ছিল। অতিথি আপ্যায়নে আনন্দ ছিল। এগুলো গ্রামীণ জনপদের খুব সাধারণ মানুষের কথা। বাংলাদেশে তখনও পোশাক বিপ্লব আসেনি। পরিবারের কারোরই তখন একটার বেশি জামাকাপড় থাকা প্রয়োজন মনে করত না। বছরে একবার ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সাধ্যমতো ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন কাপড় বরাদ্দ হতো। প্রয়োজনের অধিক বাহুল্য কাপড়চোপড়ের আড়ম্বর তখন ছিল না।
এখনকার মতো অত্যাধুনিক সাবান, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট পাউডারের সরবরাহও ছিল না। অবস্থাপন্ন পরিবারে গায়ে মাখা সুগন্ধি সাবান, কাপড়কাচা সাবানের ব্যবহার থাকলেও সাধারণ পরিবারে তা কালেভদ্রে জুটতো। নিত্য ব্যবহার্য কাপড়চোপড় পরিস্কার করতে সোডার ব্যবহার ছিল বেশি। এছাড়া দরিদ্র পরিবারে সোডার বিকল্প হিসেবে কলার পাতা পুড়িয়ে ছাই করে নিত। বড়ো কড়াইয়ে ফুটন্ত পানিতে সেই ছাই দিয়ে কাপড় সিদ্ধ করা হতো। তারপর পাটে ফেলে সেই কাপড় কাচলে ধবধবে পরিস্কার হতো। বউ- ঝিয়েরা পুকুরের পানিতে এঁটেল মাটি, তেঁতুল, সরিষার তেল ভাঙানো খৈল দিয়ে মাথার চুল পরিস্কার করতো। থালাবাসন, হাঁড়ি পাতিল মাজতে ছাইয়ের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য।
এখন সহজেই ধান চাতালে দিয়ে চাল বানিয়ে ঘরে আনা যায় অথচ পঞ্চাশ বছর আগেও অধিকাংশ পরিবারে তৈরি করতে হতো ঢেঁকিছাটা চাল। প্রায় বাড়িতে ঢেঁকি ছিল। বাড়িতে ধান সিদ্ধ করে তারপর ঢেঁকিতে সেই ধান ভানতে হতো। ঢেঁকিতে পাড় দেয়ার কাজটি করত গরীব কিষাণীরা টাকার বিনিময়ে অথবা মণ প্রতি আড়াই সের চাল এর বিনিময়ে। কখনো সাথে একবেলা খাবার খেতে পেত। ডাল ভাঙা যাতার ব্যবহার হতো গৃহস্থ বাড়িতে। গরু দিয়ে ঘানিগাছে সরিষার তেল, নারকেল তেল ভাঙানো হতো। বোতলজাত তেল কিনতে পাওয়া যেত না এখনকার মতো। সয়াবিন তেলের চল তখনও আসেনি। বাংলাদেশে সরিষার তেলই ছিল রান্নার জন্য অপরিহার্য। তবে গরু দিয়ে না হলেও মেশিনে ভাঙানো সরিষার তেলের চাহিদা এখনো আছে এবং পাওয়া যায়।
গৃহপালিত পশু হিসেবে গরু- মহিষ, ছাগল গ্রামের প্রায় বাড়িতেই থাকতো। গরু ছাগল বাঁধা বা অন্যান্য কাজে নিত্যপ্রয়োজনীয় যে দড়ি সেটা এখনকার মতো কিনতে পাওয়া যেত না। বাড়ির মুরুব্বিরা টাকুর নামে একটা বিশেষ জিনিসের সাহায্যে পাট থেকে সুতলি পাকাতেন। সেইটা প্রয়োজন মতো দুই বা তিন ভাজ করে দড়ি পাকানো হতো। অনেকে টাকার বিনিময়েও টাকুরে সুতলি পাকিয়ে দিত। টাকুরের ব্যবহার বর্তমানে একেবারেই উঠে গেছে। বিভিন্ন ধরনের নাইলন দড়ি এখন কিনতে পাওয়া যায়।
বিয়ে-শাদিসহ অধিকাংশ উৎসব আয়োজনই অগ্রহায়ণ- পৌষ বা শীতকাল ঘিরে মাথায় রাখা হতো। আমনধান বা শীতকালীন ফসল উঠে যাওয়ার পর কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকতো। গ্রামীণ জীবনযাত্রায় এই সময়টা ছিল বিনোদন কিংবা তৃণমূল সাংস্কৃতিক চর্চার। বাজার এলাকায় আয়োজন হতো যাত্রাপালা, ভাবগান, জারিগানের। বিভিন্ন ধরনের খেলার আয়োজন, প্রতিযোগিতা, পাড়ায় পাড়ায় শীতের রাতে গান গেয়ে চাল তুলে বনভোজন করা, পুথিপাঠের আসর এসব ছিল গ্রামীণ জনপদের বিনোদনের বিষয়। যান্ত্রিক বিনোদন তখন ছিল না বললেই চলে। পঞ্চাশ বছর আগের মানুষ বিনোদন বলতে বুঝতো খেলাধুলা, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি, আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, গল্প-গুজব, আড্ডা। ঘরে ঘরে চলতো পিঠাপুলির আয়োজন। খেজুর রসের পায়েস, নলেনগুড়ের পিঠা, সকালের টাটকা খেজুর রসের সাথে গরম ভাজা মুড়ি এসব ছিল গ্রামের শীতকালীন সৌন্দর্য।
টেলিভিশন গ্রাম এলাকায় ছিল না কারণ বিদ্যুৎ গ্রামে পৌছেছে অনেক পরে। দুএক বাড়িতে রেডিও ছিল। বিনোদন বা খবরের জন্য রেডিওর উপর এতটাই নির্ভরশীল ছিল যে প্রায়ই দেখা যেত দূর দূরান্তে কেউ গেলে সাইকেলে রেডিও ঝুলিয়ে নিয়ে যেত।
সাংস্কৃতিক জগতেও এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। গ্রামের মানুষ যার নামও শোনেনি বিশ বছর আগেও। হয়েছে আরও অনেক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তন একদিকে যেমন বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়েছে আবার আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সুস্থ সংস্কৃতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। দেশীয় লোকসংস্কৃতির সাথে জড়িত অনেক কিছুই এখন বিলুপ্তির পথে। গ্রামীণ মেলায় লাঠিখেলা, পালাগান, ভাবগান, যাত্রাপালা, অনুষ্ঠান বাড়িতে গানের আসর, গ্রামে গ্রামে খেলাধুলা এবং সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে ক্লাবঘর থাকতো যা এখন বিলুপ্তপ্রায়। এর ফলে তরুণ, যুবসমাজের মানসিক সৃজনশীলতা ও বিনোদনের সুযোগ নষ্ট হয়েছে এবং তারা নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রতি অধিক আকৃষ্ট হচ্ছে। মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও গ্রামাঞ্চলে সাধারণ ধুমপানের বাইরে নেশা দ্রব্যের নাম তেমন শোনা যায়নি। আধুনিকায়নের সাথে সেই ধুমপানেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। সেই সময় যারা কৃষিকাজ করতেন তারা একপ্রকার পাতার বিড়ি ধরিয়ে ধুমপান করতেন। মাঠে যাওয়ার আগে তারা খড়বিচালি শক্ত করে পাকিয়ে বেশ লম্বা একটা জিনিস তৈরি করতেন। তার একমাথায় আগুন ধরিয়ে রাখলে তাতে সারাদিন আগুন থাকত। একে বোন্দা বলা হয়। আর ছিল হুঁকো, যা নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি। হুঁকোর আগুন আলাদা। মালসায় কাঠের আগুন জ্বেলে হুঁকোর আগুন তৈরি হতো। হুঁকোর ব্যবহার ভদ্র সমাজেও ছিল। হুঁকোর উন্নত সংস্করণ গড়গড়া যা সম্ভ্রান্ত পরিবারের কর্তা ব্যক্তিরা ব্যবহার করতেন। অতিথি আপ্যায়নেও এর ব্যবহার হতো।
পরিবর্তন শুধু মানুষের ব্যবহারিক জীবনে হয়েছে এমন নয় পরিবর্তন হয়েছে প্রকৃতিতেও। কখনো তা মানবসৃষ্ট কখনো আবার প্রকৃতিগত।
আমাদের আধুনিক জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম হয়তো জানবেও না একসময় সড়কের পাশ ধরে কত বড়ো বড়ো বৃক্ষ ছিল। যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা এসব সড়কের পাশে যে ধরনের বৃক্ষ ছিল অত বড়ো বৃক্ষ তৈরি হতে কতশো বছর লাগে তা বোধগম্য নয়। কিছুদূর পরপরই ছিল পুকুর, জলাশয়। বৃক্ষনিধন, জলাশয় ভরাট সহ তাপ শোষনকারী ব্যবস্থাকে আমরাই ধ্বংস করেছি। যার প্রভাব প্রকটভাবে পড়েছে ঋতু বৈচিত্র্যে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শীতের তীব্রতা জনজীবনে মারাত্মক দুর্ভোগের সৃষ্টি করেছে।
প্রকারন্তরে মনে হয় মানুষই সবচেয়ে আগ্রাসী এবং ক্ষুধার্ত জাতি যারা পৃথিবীটাকে গ্রাস করতে চায়। এটি নেতিবাচক ভাবনার প্রকাশ নয় প্রত্যক্ষদৃষ্টে এমনই মনে হয়। আবার এটাও সত্যি এই মানুষই পারে প্রকৃতির নিয়মের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সুন্দর পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করতে। শুভবুদ্ধি, কল্যাণময় চিন্তার প্রকাশ হোক পৃথিবীময় এমনটাই শুভকামনা।
হয়তো অনেক কিছুই বাকি থেকে গেছে যা আমরা ফেলে এসেছি। আমার ক্ষুদ্র চিন্তাশক্তি, দৃষ্টির সীমিত পরিধি এবং সামান্য অভিজ্ঞতায় যেটুকু সম্ভব হয়েছে সেটুকুই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।

আরও খবর

Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)
Ad for sale 225 x 270 Position (3)
Position (3)
🔝