gramerkagoj
মঙ্গলবার ● ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১ মাঘ ১৪৩১
gramerkagoj
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)
এক প্রজন্মের একাল সেকাল (১ম পর্ব)
প্রকাশ : রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর , ২০২৪, ০৮:২৫:০০ পিএম
মাহমুদা রিনি:
GK_2024-12-29_67715c39a35f1.jpg

সেকাল বলতে খুব বেশি দিনের কথা নয় এক জীবনের একাল সেকাল। পঞ্চাশের দশক থেকে বা বয়সে পঞ্চাশোর্ধ যারা আছেন তাদের জন্ম থেকে শৈশব-কৈশোরের যে স্মৃতি, সেই সময়ের যে পরিবেশ আর এখনকার সময়ের পার্থক্য ভাবলে বিস্ময়কর মনে হয়। সবকিছুরই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী কিন্তু এত অল্প সময়ে এত দ্রুত পরিবর্তন কী সব কালেই হয়েছে বা আগামীতেও চলমান থাকবে? তাহলে সেই পরিবর্তনের সংজ্ঞা কেমন হবে! আগামী পঞ্চাশ বছর পরের সময়কে সেই হিসেবে নির্ণয় করা সত্যি কঠিন। বিশেষ করে যাদের জন্ম গ্রামে, অথচ পরবর্তী জীবনে তারা নাগরিক জীবন যাপন করছেন তাদের কাছে এই পরিবর্তন আরও অবিশ্বাস্য মনে হওয়ার কথা।
আমরা যারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছি আবার নগরকেন্দ্রিক জীবনেও অভ্যস্থ আমাদের দেখা চারপাশের পরিবেশ, দৈনন্দিন ব্যবহার্যসামগ্রী, বড়ো হয়ে ওঠার সাথে পারিপার্শ্বিক দায়িত্ববোধ, চিন্তা -চেতনার বহিঃপ্রকাশ এইসময়ের থেকে পুরোমাত্রায় ভিন্নতর, আবার বদলে যাওয়া সময়ের ধারাবাহিকতার সাথে একাঙ্গী ভাবে জড়িত। তাই মনে হয় এই প্রজন্ম অদ্ভুত এক পরিবর্তনশীল সময়ের সাক্ষী।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস আমার নেই। আমি শুধু পথ চলতে যা কিছু চোখে দেখা বা শোনা, তার সাথে নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশের চেষ্টা করেছি।
এলাকার অবস্থান নির্দিষ্ট করলে বা না করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না কারণ বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামাঞ্চলের চিত্র একই রকম। এটা সত্যি এখন যারা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন তাদের অধিকাংশেরই বড়ো হয়ে ওঠা গ্রামে এবং অভিজ্ঞতায় তারা আমার সাথে একমত হবেন। তবু যদি লেখার স্বার্থে আমার এলাকা তুলে ধরি সেটাও সারা গ্রামবাংলার চিত্র মনে হবে। আমার জন্মস্থান বারবাজার থেকে ছয় মাইল পশ্চিমে যাত্রাপুর গ্রামে। বারবাজার থেকে হাকিমপুর আট মাইল পুরোপুরি কাঁচারাস্তা ছিল যা এখন দেখে বোঝার উপায় নেই। রাস্তার দুধারে ঘন বন আর উঁচু উঁচু ঢিবি। বর্ষাকালে জায়গায় জায়গায় হাঁটু সমান কাদা। শীতের সময় ধুলোয় রাস্তার পাশের গাছপালা ধুসর।
বারবাজার অত্র অঞ্চলের বর্ধিঞ্চু ও পুরাতন আমলের পুরাকৃতি সমৃদ্ধ বাজার। ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর এই অঞ্চল বৃহত্তর যশোর জেলার অন্তর্গত ছিল। বর্তমানে বারবাজার ঝিনাইদহ জেলায় হলেও যাত্রাপুর- হাকিমপুর ইউনিয়ন যশোর জেলার মধ্যে।
খুলনা থেকে বারবাজার হয়ে কুষ্টিয়া, মাগুরা বাস চলাচল করলেও অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ছিল অধিকাংশে ব্যক্তিনির্ভর। অত্র অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য সেই সময় গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, বাইসাইকেল আর সাধারণের জন্য পায়ে হাঁটার কোনো বিকল্প ছিল না! পাঁচ ছয় মাইল হেঁটে বাজারে কেনাবেচা করতে যাওয়া ছিল সাধারণ ব্যাপার। এমনকি বিশ- পঁচিশ মাইল রাস্তাও মানুষ অনায়াসে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দিত। নারীদের জন্য ছিল গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা। ভাড়ায় ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যেত। আগের দিন বলে রাখলে পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে গাড়ি বাড়িতে হাজির হতো। সাধারণ বিয়ে-শাদি, বরযাত্রী, নতুন বউ আনা-নেওয়া সবই ঘোড়ার গাড়িতে হতে দেখেছি। ঘোড়ার গাড়িতে ঘন্টা বেঁধে বরযাত্রীর দল তাদের আগমন জানান দিতে দিতে কনের বাড়ি উপস্থিত হওয়ার আনন্দ ছিল চমৎকার এবং উপভোগ্য। বড়ো আয়োজনের বিয়েতে অবশ্য বাস বা মোটরগাড়ী ভাড়া করা হতো। মাইক বাজিয়ে গান চলতো দুই থেকে পাঁচদিন পর্যন্ত। দেবদারু পাতা আর রঙিন কাগজের গেট সাজিয়ে বরপক্ষকে অভ্যর্থনা জানানো এবং তর্কাতর্কিও হতো, কখনো কখনো উভয় পক্ষের দুই-একজন ইংরেজি জানা ব্যক্তির ইংরেজিতে বাকযুদ্ধ মনোরম ও কৌতুকপ্রদ মনে হতো।
পথের কথায় ফিরে আসি, যাতায়াতের সেযুগে যখন বাস চলাচল ছিল সীমিত। রিকশা, স্কুটার ছিল শহরকেন্দ্রিক, মোটরসাইকেল ছিল হাতে গোনা দুইএক ধনী পরিবারের বাহন।
তখন গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি করেই মানুষ দূর দুরান্তে গিয়েছে। বউ-ঝিয়েদের নাইওর যেতে হতো এভাবেই।
মায়ের মুখে গল্প শুনেছি দূরের কোনো গ্রামে একপাড়ায় দুতিন মেয়ে- বউয়ের বাপেরবড়ি, শ্বশুরবাড়ি হলে তাদের একসাথে একটা গরুর গাড়িতে আসা-যাওয়ার সুবিধা হতো। বাচ্চাকাচ্চা ও দুরত্ব বুঝে সাথে চিড়ামুড়ি এমনকি ভাত-তরকারি বেঁধে নিয়ে রওনা দিতো। গাড়িতে লন্ঠন ঝোলানো থাকতো। পথে রাত্রি হলেও যেন অসুবিধা না হয়। বাড়ির গাড়ি এবং চালকও বাড়ির কর্তা বা অন্য সদস্যদের কেউ। এরকম যাতায়াতের পথে দুএক ঘর আত্মীয় স্বজন থাকলে সেখানে যাত্রাবিরতি করে বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় রওনা দিতো। অবস্থাপন্ন পরিবারের নাইয়র হলে অবশ্য দিনের আলোয় গন্তব্যে পৌছনোর তাড়া থাকতো কারণ পথে চুরি- ডাকাতির ভয়ও ছিল তবে তা খুবই কম। ভাবলে অবাক লাগে এখন হয়তো বেশি হলেও দুই তিন ঘন্টার পথ। এক গ্রামে অনেক আত্মীয় থাকার একটা কারণ ছিল কুলীন পদবি প্রথা। কৌলিন্য বজায় রাখতে বিশেষ কিছু বংশের পদবির বাইরে বিয়ে হতো না। যে কারণে আত্মীয় স্বজন নির্দিষ্ট অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকতো। সময়ের সাথে রীতিনীতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পদবি প্রথা প্রায় উঠেই গিয়েছে। তবু এখনো কিছু গ্রাম আছে যেখানে পদবিপ্রথাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
যতদূর মনে পড়ে আশির দশকের শুরুতে তিন চাকার ভ্যানগাড়ির আবির্ভাব হয়। সেই ভ্যানগাড়িতে ছই লাগিয়ে নারীদের যাতায়াত ব্যবস্থা চালু হয়। কাঁচা রাস্তা বর্ষাকালে কিছু কিছু জায়গায় কাদাপানিতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো যে কোনো গাড়ির চাকাই সেই কাদা অতিক্রম করে এগোনো সম্ভব ছিল না, ভ্যান তো নয়ই। অগত্যা গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে কাদা পার হতে হয়েছে। ধীরে ধীরে ভ্যানগাড়ির ছই উঠে যেয়ে এখন এলাকার সহজ বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভ্যানের সাথে যোগ হয়েছে ইঞ্জিন। ইঞ্জিন চালিত ছোটো বড়ো অসংখ্য পরিবহন এখন যানবাহন এবং মালামাল পরিবহনে ব্যবহার হচ্ছে। গ্রামীণ জনপদের পরিবেশ উন্নয়নে যা ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড়ো বিপ্লব ঘটিয়েছে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। মাত্র বিশ বছর আগেও গ্রামের মানুষ ভাবতে পারতো না তারা ফোনে কথা বলতে পারবে! শহরে টিএনটি ফোনের মাধ্যমে কথা বলা যেত এবং সেটার ব্যবহার শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। মোবাইল ফোনের সাথে ইদানিং গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে যা গ্রামের জীবনকে শহরের সাথে তাল মেলাতে সাহায্য করছে। চলবে....

# লেখক: সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

আরও খবর

Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)
Ad for sale 225 x 270 Position (3)
Position (3)
🔝