gramerkagoj
বুধবার ● ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩ মাঘ ১৪৩১
gramerkagoj
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)
পতাকাওয়ালা
প্রকাশ : মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর , ২০২৪, ১২:০৬:০০ পিএম
আলী ইদরীস:
GK_2024-12-17_676112becf40f.jpg

জেলা শহরের সাথে পাশাপাশি তিনটি মহকুমায় যাতায়াতের জন্য সাত মাইল ব্রিজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্রিজ পার হয়েই প্রতিদিন হানাদার বাহিনি তাদের দোসরদের নিয়ে গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে, নির্বিচারে নির্যাতন ও হত্যাসহ ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে।
কমান্ডার গাজী ভাইয়ের নির্দেশ এসেছে- এ ব্রিজ উড়িয়ে দিতে হবে। উড়িয়ে দিতে পারলেই তিন মহকুমার সাথে জেলা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। দায়িত্ব পেয়েছে ওরা ছয় মুক্তি- ফারুক, মালেক, রুহুল, পলাশ, ইউসুফ আর আবুল।
দুর্ধর্ষ গেরিলাযোদ্ধা ফারুক আর ইউসুফ মাথায় মাতাল, গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি আর হাঁটু অবধি লুঙ্গি পরে হাতে নিড়ানি, কাঁধে কোদাল নিয়ে ক্ষেতমজুরের বেশে সকালে রেকি করে এসেছে। রাতেই হবে অপারেশন। ব্রিজের তলায় ডিনামাইট লাগানো ও চার্জের দায়িত্ব পলাশ আর মালেকের। গ্রেনেড হাতে সদা প্রস্তুত থাকবে আবুল আর রুহুল। ফারুক আর ইউসুফ অবিরাম গুলি ছুঁড়বে। অপারেশন শেষে যে যার মতো ছুটে নিরাপদ অবস্থানে চলে যাবে। সবই পরিকল্পিত।
ব্রিজের নিরাপত্তার জন্য রাস্তার পাশে তাঁবু ফেলে অস্থায়ী ক্যাম্প বসিয়েছে হানাদার বাহিনি। সেখানে পালাক্রমে পাহারা দেয় রাজাকাররা। তাই গভীর রাতে ঘটাতে হবে ঘটনা।
ব্রিজ থেকে আধামাইল দূরে অবস্থিত মসজিদের মোয়াজ্জিন হাফেজ মওলানা মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁর দু’কক্ষ বিশিষ্ট মাটির ঘরের একটি কক্ষে আজ মধ্যরাত পর্যন্ত ছয় বিচ্ছিুকে সেল্টারের সুযোগ দিয়েছেন। স্ত্রী-পরিজনকে ক’দিন আগেই তিনি শ^শুর বাড়িতে রেখে এসেছেন।
মগরেবোত্তর সন্ধ্যায় আলোহীন মোয়াজ্জিনের ঘরে ফারুক, রুহুল আর ইউসুফ অপারেশনে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এমন সময় বাঁশঝাড়ের অন্ধকার মাড়িয়ে আবুল ঘরে প্রবেশ করলো। ফারুক ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
-খবর কিছু পেয়েছিস?
-মালেক আর পলাশ শক্তিশালী ডিনামাইট নিয়ে পৌঁছে গেছে।
-ওরা কখন লাগানো শুরু করবে?
ইউসুফের জিজ্ঞাসা।
-ঈশার নামাজ শুরু হলেই ওরা কাজ শুরু করবে।
-তাহলে তো আমাদেরও বেরিয়ে পড়া দরকার। তুইও জলদি গুছিয়ে নে।
আবুলকে উদ্দেশ্য করে বললো ফারুক। আবুল বললো,
- ব্রিজ উড়ানোর আগেই আমি রাজাকারদের খতম করতে চাই।
- না না, এ কাজ করা যাবে না। তাহলে আসল উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে।
- ঠিক বলেছিস।
ফারুককে সমর্থন করলো রুহুল। ওদের কথার মাঝে সন্তর্পণে ঘরে ঢুকলেন মোয়াজ্জিন সাহেব। বললেন,
- বাবারা কী রেডি?
- জ্বি হুজুর। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
- তোমরা সফল হও- কায়মনোবাক্যে এই দোয়া করি। বিজয়ীর বেশে তোমরা ঘরে ফিরবে ইনশাল্লাহ।
-আপনার এই সহযোগিতার কথা আমরা সারাজীবন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো।
-এ তো আমার কর্তব্য। এদেশ তো আমারও। মৌলবী-মওলানা আর টুপি-পাঞ্জাবী পরা কিংবা দাড়িওয়ালা হুজুরেরা সবাই পাকিস্তানের পক্ষে না। পাকিস্তানিরা তো ধর্মের নামে জঘন্য অপরাধ করছে।
-কিন্তু‘ মসজিদ কমিটির সভাপতি হাফেজ মওলানা গফুর কাজী তো যুবতী মেয়েদের ধরে ধরে খানসেনাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। মুক্তিসেনাদেরকে দুস্কৃতিকারী বলছে, ইসলামের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানিদের সব অপকর্মের সমর্থন করছে।
ইউসুফের কথার জবাবে মোয়াজ্জেম হোসেন বললেন,
-তার বিচার স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন করবেন। মনে রেখেÑ ইসলাম শান্তির ধর্ম। নিরীহ মানুষ হত্যা, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ এসব ইসলাম ধর্ম সমর্থন করে না।
মোয়াজ্জেম হোসেনের এ কথায় ফারুক, রুহুল, ইউসুফ আর আবুলের তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। ওরা তাঁকে কদমবুছি করতে উদ্যত হতেই তিনি ওদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
ওরা আর কথা না বাড়িয়ে অস্ত্রসহ ঘরের পাশের বাঁশবাগানের ভিতর দিয়ে অন্ধকারে মিশে গেলো। ওদের সাথী হলো জোনাকীর মিটি মিটি আলো।
ঈশার নামাজ শেষ হয়েছে বেশখানিক আগে। মোয়াজ্জেম হোসেন মসজিদ থেকে ঘরে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেন। বিশ্রাম শেষে অজু করে হারিকেনের স্বল্প আলোয় কোরআন শরিফ খুলে তেলাওয়াত শুরু করেন। খুব দরদ দিয়েই তেলাওয়াত করেন তিনি। কিন্তু মনের মধ্যে আজ কেমন যেন অস্থিরতা। কাংখিত সেই মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন।
রাত ক্রমশ গভীর হয়। প্রকৃতিতে সুনসান নীরবতা। এরই মাঝে শিয়ালের সমস্বরে ‘হুক্কাহুায় ডাক’ জানান দেয় মধ্যরাতের বার্তা।
তারও কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ডিনামাইটের বিকট বিস্ফোরণের শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সাথে সাথেই গ্রেনেড আর গুলির বিরতিহীন শব্দে কেঁপে ওঠে চারদিক। মোয়াজ্জেম হোসেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আরো উচ্চকিত স্বরে কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকেন।
ফজরের নামাজ শেষ হতেই মসজিদ কমিটির সভাপতি গফুর কাজী উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশে ভীত-সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বললেন,
-এ তল্লাটে দুস্কৃতিকারীরা ঢুকে পড়েছে। রাতে মেজর হায়াত খান কয়েকজন আর্মি নিয়ে ব্রিজ পার হবার সময় দেশের শত্রু মুক্তিরা জিপসহ সাত মাইল ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে। ব্রিজ পাহারারত সা”চা দেশপ্রেমিক আমাদের রাজাকার ভাইয়েরা সবাই শহীদ হয়েছে। একজন দুস্কৃতিকারীও নিহত হয়েছে। নিশ্চয় আমাদের মধ্যে কোন গুপ্তচর আছে। তাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে।
গফুর কাজীর কথা শেষ হতেই মুসল্লিদের মধ্য থেকে গ্রামের দরিদ্র কৃষক বলু বিশ্বাস ডুকরে কেঁদে উঠে গফুর কাজীর দিকে ধেয়ে গেলেন। বললেন,
-তুমি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে জোর করে আমার আদরের দুলাল জয়নালকে রাজাকার বানিয়েছো। আমি গরীব মানুষ, বুড়ো হয়েছি। জয়নালই ছিল আমার একমাত্র সম্বল। তুমি একজন খুনি। রাজাকার বানিয়ে তুমি আমার জয়নালকে খুন করেছো।
-জয়নাল দেশের জন্য জীবন দিয়েছেÑ শহীদ হয়েছে। আখেরাতে তুমি শহীদ পিতার মর্যাদা পাবে।
-রাখো তোমার গালভরা বুলি। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের কথা কেউ ভাবে না। তুমি নিজের স্বার্থের জন্য নিরীহ অবুঝ ছেলেদের মৃত্যুর মুখে ঢেলে দিচ্ছো। আখেরাত তোমাকে জবাব দিতে হবে।
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু বলতে পারলেন না সন্তানহারা বলু বিশ্বাস। মোয়াজ্জিন সাহেব দ্রুত তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
-শান্ত হোন বলু চাচা, শান্ত হোন।
বলু বিশ্বাস মোয়াজ্জিন সাহেবের বুকে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। উপস্থিত মুসিল্লরা একে একে আসেন বলু বিশ^াসের কাছে। সবাই তার প্রতি সহানুভূতি জানাতে থাকেন।
পরিস্থিতি এমনভাবে মোড় নেবে ভাবতে পারেননি গফুর কাজী। ভেবে ছিলেনÑ সবাই তার প্রতি অনুগত থাকবে। কিন্তু হলো তার উল্টো। এখানে থাকা আর উচিত হবে না ভেবে তিনি চুপিসারে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
দুই
সময় বহতা নদীর মতো বয়ে যায়। একাত্তরের তরুণ বয়সী দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হোসেনও এখন সময়ের ব্যবধানে মধ্য বয়সে উপনীত। সাত মাইল ব্রিজ উড়িয়ে দেবার মতো আরো অনেক অপারেশনে সাফল্য অর্জন করলেও স্বাধীন দেশে অভাবের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছে। দরিদ্র বাবার সন্তান ফারুক কোন রকমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলো। তার দু’বছর পর এলো রক্তঝরা একাত্তর। স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে বন্ধুদের সাথে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছিল। ট্রেনিং শেষে শত্রু কবলিত স্বদেশে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে।
দেশ স্বাধীন হলো। অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও ফারুকের ভাগ্যের পরিবর্তন হলো না। স্ত্রী আর তিন সন্তান নিয়ে অভাবের বিরুদ্ধে নিত্য সংগ্রাম করে এখনো টিকে আছে। নিয়মিত আয় বলতে যৎসামান্য মাসিক মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। পেটের দায়ে হয়েছে ভ্যান চালক।
এতো কষ্টের মাঝেও ডিসেম্বর আর মার্চ মাস এলেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক। ফিরে যায় সে একাত্তরে। বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবসকে স্মরণ করিয়ে দিতেই মাসের শুরুতেই মফস্বল ছেড়ে চলে আসে ঢাকায়। হয়ে যায় ফেরিওয়ালা।
না, সে পান-সিগারেট-চা কিংবা ঝালমুড়ি-বাদাম বিক্রি করে না। সাত-আট ফুট লম্বা বাঁশের লগিতে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা লাল-সবুজ রংয়ের ছোট-মাঝারি-বড় সাইজের পতাকা বেঁধে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ঢাকার রাজপথে, অলিতে গলিতে- যেন এক চলমান বাংলাদেশ! অন্য কাঁধে ঝুলানো কাপড়ের ব্যাগে থাকে অবশিষ্ট পতাকা। মুখে কাঁচা-পাকা খোঁজা খোঁজা দাড়ি, মাথায় লাল-সবুজ ক্যাপ- একেবারে ভিন্ন এক ফারুক। টিএসসি মোড়, শাহাবাগ, শহীদ মিনার, নীলক্ষেত সর্বত্রই পতাকাওয়ালা ফারুক ছুটে বেড়ায়। পথচারীকে ডেকে বলে- ‘পতাকা নেবেন ভাই, পতাকা।’
অনেকেই কেনে, আবার অনেকে পাশ কেটে চলে যায়। হতাশ হয় না ফারুক। যা বিক্রি হয় তাতেই সে খুশি। পরদিন নতুন উদ্যোমে শুরু করে আবার পথচলা। দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যায় পতাকাওয়ালা ফারুক। দু’চোখে স্বপ্ন দেখে- একদিন ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন হবে।
এখানেই গল্পটা শেষ হতে পারতো। কিন্তু হলো না। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তরুণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী কোহিনূর জেবা বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছে পতাকাওয়ালা ফারুককে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত এই মানুষটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার দারুণ এক সংগ্রামী পথ বেছে নিয়েছে। যতই দেখছে ততই তার প্রতি কোহিনূরের শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যাচ্ছে। অনুসন্ধানী জেবা ডিসেম্বরের এক বিকেলে তাকে নিয়ে বসে পড়লো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় লাইব্রেরি চত্বরে। সবিস্তারে জানতে চাইলো তার জীবনের কথা। পতাকা ফেরির কারণও জানতে চাইলো।
মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ফিরে যায় সেই একাত্তরে। কেমন করে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলো। সাত মাইল ব্রিজ পাহারারত রাজাকার আর খানসেনা বহনকারী জিপ ব্রিজের উপরে উঠতেই জীবন বাজি রেখে ব্রিজ উড়িয়ে দেবার ঘটনা, ডিনামাইট চার্জ করে নিরাপদ দূরত্বে দ্রুত সরে যেতে না পারায় সহযোদ্ধা মালেকের করুণ মৃত্যুসহ যুদ্ধের অন্যান্য অপারেশনের কথা সাবলীলভাবে শোনালো। পতাকাওয়ালা হয়ে প্রতি বছর বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবসে ঢাকা আগমনের কারণও তুলে ধরলো। বাদ রাখলো না অভাব-অনটনে জর্জরিত জীবন সংগ্রামের কথা।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোহিনূর জেবা ফারুকের জীবনকথা লিপিবদ্ধ করতে পেরে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবতী মনে করলো।
কিন্তু ফারুক হোসেন বুঝে উঠতে পারছে না যে তার মতো একজন হতদরিদ্র ফেরিওয়ালার জীবন কাহিনি কেন জানতে চাচ্ছে? কৌতূহলের বশে জেবাকে প্রশ্ন করলো,
-আচ্ছা মা মণি, তুমি আমার কাছে এত কিছু জানতে চাচ্ছো কেন?
হেসে ফেললো জেবা। এমন প্রশ্ন যে হবে তার জন্য যেন আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো সে। চট করে উত্তর দিলো,
-বেশ কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করছি আপনি বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবসে পতাকার ফেরিওয়ালা হয়ে ঢাকা শহরে ছুটে বেড়ান। নিশ্চয় এর পিছনে কোন কাহিনি আছে। আমার মনে হয়েছে আপনি কোন সাধারণ ফেরিওয়ালা নন।
ফারুক একটি দীর্ঘ নিঃশ^াস ছেড়ে বললো,
-যুদ্ধদিনের কথা ভুলতে পারি নারে মা। এ কালের ছেলেমেয়েদের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিতেই আমি রক্তরাঙা পতাকা ফেরি করার মাধ্যমে আরেক মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছি।
-এ যুদ্ধে আপনি একা নন। আমি- আমরাও আছি আপনার সাথে। আপনার এই মহান চেতনা ছড়িয়ে দেবো দেশ বিদেশের মানুষের কাছে।
-তোমার স্বপ্ন পূরণ হোক এই দোয়া করি।
-না চাচা, কথাটা ঠিক হলো না। আপনার স্বপ্ন পূরণ করবো আমরা, আপনাদের উত্তরসূরিরা।
জেবার কথায় ফারুক হোসেনের চোখে পানি চলে এলো। মেয়েটি তাকে যেভাবে আপন করে নিয়েছেÑ যেন সে তার নিজেরই মেয়ে। আবেগ ধরে রাখতে পারলো না। বলেই ফেললো,
-তুমি কে গো মা? মনে হয় তুমি যেন আমার নিজের মেয়ে!
- আমার বাবাও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝেই আমি আমার বাবাকে খুঁজে ফিরি। আমি গর্বিত যে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
আবেগে জেবার কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসে। ফারুক হোসেনের হৃদয়ে পিতৃস্নেহ প্রবল হয়ে ওঠে। জেবার মাথায় হাত রেখে ¯েœহের পরশ বুলিয়ে দিতে থাকে। জেবার মনে হলোÑ যেন তার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ আলী তার মাথায় পরম স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।
দু’দিন পরে একটি জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকে মুক্তিযোদ্ধা ফারুকের ‘জীবনকথা’ গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হলো। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য কোহিনূর জেবা প্রশংসায় ভাসছে। ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রশিক্ষক মিলনায়তনে কোহিনূর জেবার উদ্যোগে নবগঠিত ‘আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-চেতনার উত্তরসূরি’ সংগঠনের ব্যানারে আয়োজন করলো ফারুকের জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের। সেই অনুষ্ঠানে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের হাতে তুলে দিলো সংগৃহীত ত্রিশ হাজার টাকা। শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অনেকেই বক্তব্য রাখলেন। স্যালুট জানালেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুককে। অনন্য এই উদ্যোগের জন্য প্রশংসা করলো তরুণ সাংবাদিক কোহিনূর জেবাকেও।
বিরল এই সম্মানে হতবাক ভ্যান চালক- পতাকা ফেরিওয়ালা ফারুকের চোখে আনন্দাশ্রু। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কয়েকটি চ্যানেলের সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার ধারণ করলো।
এরপরের ঘটনা আরো বিস্ময়কর। নিজ জেলা শহরে সরকারি জিলা স্কুলে অফিস সহায়ক পদে ফারুকের চাকরি হলো। সরকারি খাসজমি বরাদ্দ দিয়ে মাথা গোঁজার ¯’ায়ী ঠিকানা গড়ে দিলো জেলা প্রশাসন।
এতকিছুর পরেও পতাকাওয়ালা ফারুক ফি বছর বাঙালির অহংকার আর গর্বের বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে আগের মতোই পতাকা নিয়ে ছুটে আসে ঢাকায়। ঘুরে বেড়ায় রাজপথ, অলি-গলি আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
না। এখন আর সে টাকার বিনিময়ে পতাকা বিক্রি করে না। নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত ও জাগ্রত রাখতে বিনামূল্যে পতাকা তুলে দেয় শিশু-কিশোর, ছাত্র-ছাত্রী, রিকসাওয়ালা আর পথচারিদের হাতে।
# লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, কবি, কথাসাহিত্যিক

আরও খবর

Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)
Ad for sale 225 x 270 Position (3)
Position (3)
🔝