শিরোনাম |
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভা বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন শিক্ষার্থীরা বর্তমানে মাদরাসা শিক্ষায় ঝুঁকে পড়ছে। এ কারণে আগের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বিভিন্ন এলাকার অভিভাবকরা সন্তানদের ইসলাম শিক্ষা দিয়ে পরবর্তী সময় বিদ্যালয়ে ভর্তি করাচ্ছেন। বেশির ভাগ অভিভাবকের ইচ্ছে তারা তাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন। যার কারণে তারা নূরানী মাদরাসায় তাদের ছেলে মেয়েদের ভর্তি করাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ উপজেলায় কেরাতুল কোরআন ৩৫টি, নূরানী মাদরাসা ১২০টি, হেফজখানাসহ ৪৫টি রয়েছে। এগুলো নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়ে আসছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা নিজেরা টাকা দিয়ে পড়াশোনা করছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১৭১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩২ হাজার সাত শত ৪১জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ১০১ জন সহকারী শিক্ষক ও ৩৫ জন প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে কিন্তু ১৮ পদ প্রধান শিক্ষক নিয়ে রয়েছে মামলা। আবার ৪টি সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা, ১জন হিসাব সহকারি, ১জন উচ্চমান সহকারি , ১জন অফিস সহকারি পদ শুন্য রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় ওই সব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক শৃঙ্গলাও ভেঙে পড়েছে। শিক্ষক স্বল্পতায় মানসম্মত ফলাফলের দিক দিয়েও পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই অভিভাবকদের। অনেক বিদ্যালয় সহকারি শিক্ষা অফিসার বছরে একবার ভিজিট করতে যান না। এজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকেরা তাদের ইচ্ছামত ক্লাশ করছেন। তাদেরকে কারো কাছে জবাব দিহিতা করতে হয় না।
নূরানী মাদরাসায় পড়–য়া শিক্ষার্থীর অভিভাবক মো: নুরুজ্জামান, নাসরিন বেগম ও খাদিজা খাতুন বলেন, সন্তান মাদরাসায় দিয়েছি। বাংলা, ইংরেজি, অংক, আরবি ও সাধারণ জ্ঞান ভালো ভাবে জানবে তারপর আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলে মেয়েদের ভর্তি করিয়ে দিব। অভিভাবকরা আরো বলেন, নূরানী মাদরাসার শিক্ষকরা নিয়মিত শিশুদের পাঠদান করেন ও বাড়িতে গিয়ে খোঁজ খবর রাখেন। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন শিক্ষার্থীরা মাদরাসা শিক্ষায় ঝুঁকে পড়ছে উপজেলার দারুল ইহসান মডেল মাদ্রাসায় প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত দুই শত ৭৫ শিক্ষার্থী রয়েছে।
এ দিকে উপজেলার যে সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম তা হচ্ছে মিঠাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোলবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বানী কান্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় , নেওয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরনিশান বাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় , টিয়াখালী ১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় , লালুয়া বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় , মেহেরুনেছা সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম কিন্তু একটি বিদ্যালয ৫-৬ জন শিক্ষক রয়েছে। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকরা সরকারিভাবে বেতনসহ বিভিন্ন ভাতা পাচ্ছে আর অন্য দিকে নূরানী শিক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে ক্লাসে লেখাপড়া করেন। তবে এসব বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী কমেছে। একই সময়ে মাদ্রাসার সংখ্যা সামান্য কমলেও শিক্ষার্থী বেড়েছে।
ফলে কী কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী কমেছে, আর মাদ্রাসায় বেড়েছে, সে বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন থেকে কিছু জানা যায়নি। তবে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, এখানে করোনার একটি প্রভাব রয়েছে। গত দুই বছর ছিল করোনাকাল। এই সময়ে পড়াশোনার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। করোনার প্রভাদুর্ভাব দেখা দিলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীর ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। টানা প্রায় ১৮ মাস পর গত সশরীর ক্লাস শুরু হয়। করোনা মহামারির মধ্যে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমেছে। তবে এই সময়ে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেড়েছে।
উপজেলা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক স্বল্পতা দীর্ঘ দিনের। বছরের পর বছর সহকারী শিক্ষকের শূন্য পদগুলো পূরণ হচ্ছে না। যার ফলে পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি বাড়তি চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন নিয়মিত শ্রেণি শিক্ষকরা।
শিক্ষক সংকটে থাকা বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরাও এ নিয়ে বিরক্ত। বারবার উপজেলা শিক্ষা অফিসে ধরনা দিলেও এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাই ক্ষুব্ধ অভিভাবক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরা।
অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষক স্বল্পতার কারণে নিয়মিত পাঠদান না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের এমন ফলাফল। দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে আগামী দিনে উপজেলায় ভালো ফলাফল আসবে না। ওই বিদ্যালয়গুলোতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও পাঠদান কার্যক্রম। শিক্ষক সংকটে পড়ে চরম ভোগান্তিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। প্রতিদিনের পাঠদান কার্যক্রম চলছে কোনো রকম জোড়াতালি দিয়ে। উপজেলায় কিছু মহিলা শিক্ষক মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকায় ও বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে প্রশিক্ষণে থাকায় চলমান সংকট আরও প্রট হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন ও প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত স্থান হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষক স্বল্পতায় হোঁচট খেতে হচ্ছে।
শিক্ষক স্বল্পতায় থাকা বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেদের ইচ্ছে মতো ক্লাস নিয়ে থাকেন। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে অফিসের কাজের পাশাপাশি এক শিক্ষককে দুটি ক্লাসে ও পাঠদান কার্যক্রম চালাতে হয়। তাই শিক্ষকরা এক দিকে অতিরিক্ত কাজ আর পাঠদান কার্যক্রমে ক্লান্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে এক বা দুটি বিষয় সারাদিন পড়া নিয়ে শিক্ষার্থীরাও বিরক্ত হচ্ছে। আর এ কারণেই অনেক বিদ্যালয় ক্ষুধে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় যেতে আগ্রহ হারাচ্ছে। ওইসব বিদ্যালয় সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল ও আশানুরূপ হচ্ছে না। যেসব বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো হয় তারাও আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করতে না পারায় হতাশায় বাড়ছে।
দারুল ইহসান মডেল মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী জানান, আমাদের দারুল ইহসান মডেল মাদ্রাসায় পড়ার কারনে আমি বাংলা, ইংরেজি, অংক, আরবি ও সাধারণ জ্ঞান ভালো ভাবে জানতে পারি কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় এভাবে সুযোগ সুবিধা নেই।
এ ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অত্যুতানন্দ্র দাস বলেন, ধর্মীয় অনুভূতির কারনে অনেক অভিভাবকই তার সন্তানকে মাদ্রাসা শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বেশি সমস্যা হয়েছে করোনাকাল থেকে একটু প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা কমছে বলে তিনি জানান। করোনাকালীন প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ছিল ও নূরানী মাদরাসা খোলা ছিল তখন অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের নূরানী মাদরাসায় ভর্তি করেছে। বেশির ভাগ অভিভাবকের ইচ্ছে তারা তাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন। যার কারণে তারা নূরানী মাদরাসায় তাদের ছেলে মেয়েদের ভর্তি করাচ্ছেন।