শিরোনাম |
বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বাঙালি সমাজে প্রগতিশীল সংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান কোনোদিনও ভোলার নয়। একদিকে যেমন আধুনিক বাংলা ভাষার রূপকার, তেমনি বাল্যবিবাহ রোধ ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় রেখেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা। আজ তার জন্মবার্ষিকী।
ঈশ্বরচন্দ্র ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮২০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বিদ্যাসাগর নামেই বেশি পরিচিত। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা ভগবতী দেবী। ঈশ্বরচন্দ্র ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
চার বছর ৯ মাস বয়সে সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় শিক্ষাজীবন শুরু ঈশ্বরচন্দ্রের। পাঁচ বছর বয়সে পাঠশালায় বিদ্যাসাগরের পড়াশোনা শুরু। আট বছর বয়সে বাবার সঙ্গে হেঁটে কলকাতা যান এবং সংস্কৃত কলেজে ১২ বছর অধ্যয়ন করেন। ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, বেদান্ত ও জ্যোতিষশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তখন থেকেই ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি তার সঙ্গী।
পড়ালেখা শেষে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করেছিলেন। বাংলা ভাষাকে যুক্তিগ্রাহ্য ও সকলের বোধগম্য করে তুলেছিলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার। তিনি জনপ্রিয় শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয়সহ একাধিক পাঠ্যপুস্তক, সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থ এবং সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন।
তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আছে, ‘বর্ণপরিচয়’, ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ ও ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’। অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে আছে, ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’, ‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’ ও ‘ভ্রান্তিবিলাস’।
১৮৩০ সালে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণিতে ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৩১ সালের মার্চ মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি এবং ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা পারিতোষিক পান। সংস্কৃত কলেজে মাসিক বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের ‘পে স্টুডেন্ট’ ও অন্য ছাত্রদের ‘আউট স্টুডেন্ট’ বলা হত। অন্যদিকে তিন বছর ব্যাকরণ শ্রেণিতে পঠনপাঠনের পর বারো বছর বয়সে প্রবেশ করেন কাব্য শ্রেণিতে। সে যুগে এই শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। ১৮৩৩ সালে ‘পে স্টুডেন্ট’ হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র ২ টাকা পেয়েছিলেন। ১৮৩৪ সালে ইংরেজি ষষ্ঠশ্রেণির ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য ৫ টাকা মূল্যের পুস্তক পারিতোষিক হিসেবে পান।
১৮৩৫ সালে ইংরেজি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রূপে পলিটিক্যাল রিডার নং ৩ ও ইংলিশ রিডার নং ২ পারিতোষিক পান।
১৮৩৬ সালে অলংকার পাঠ শেষ করেন। বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে রঘুবংশম্, সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রত্নাবলী, মালতী মাধব, উত্তর রামচরিত, মুদ্রারাক্ষস, বিক্রমোর্বশী ও মৃচ্ছকটিক গ্রন্থ পারিতোষিক পান। ১৮৩৭ সালের মে মাসে তার ও মদনমোহনের মাসিক বৃত্তি বেড়ে হয় আট টাকা।
১৮৩৮ সালে সমাপ্ত করেন বেদান্ত পাঠ। এই পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং মনুসংহিতা, প্রবোধ চন্দ্রোদয়, অষ্টবিংশতত্ত্ব, দত্তক চন্দ্রিকা ও দত্তক মীমাংসা গ্রন্থ পারিতোষিক পান। সংস্কৃতে শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা পুরস্কারও পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৪০-৪১ সালে ন্যায় শ্রেণিতে পঠনপাঠন করেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই শ্রেণিতে দ্বিতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে তিনি পারিতোষিক পান। ন্যায় পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ১০০ টাকা, পদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা, দেবনাগরী হস্তাক্ষরের জন্য ৮ টাকা ও বাংলায় কোম্পানির রেগুলেশন বিষয়ক পরীক্ষায় ২৫ টাকা-সর্বসাকুল্যে ২৩৩ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন।
১৮৪৯ সালে মার্শম্যানের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচনা করেন বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থখানি। এই বছরেই ১ মার্চ পাঁচ হাজার টাকা জামিনে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে আবৃত হন। ১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৫১ সালের ৫ জানুয়ারি সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ ছাড়াও কলেজের অস্থায়ী সেক্রেটারির কার্যভারও গ্রহণ করেন। ১৮৫২ সালের এপ্রিলে ২৬ অনুচ্ছেদ সংবলিত নোটস অন দ্য সংস্কৃত কলেজ প্রস্তুত হয়। ২৮ আগস্ট থেকে কলেজে প্রবেশার্থী ছাত্রদের ২ টাকা দক্ষিণা দেওয়ার প্রথা চালু হয়। ১৮৫৩ সালে জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে স্থাপন করেন অবৈতনিক বিদ্যালয়।
১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – প্রথম পুস্তক প্রকাশিত।
১৮৫৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মেদিনীপুরে পঞ্চম বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ঈশপের কাহিনি অবলম্বনে রচিত কথামালা প্রকাশিত হয়। ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইনসম্মত হয়। এই দিনই প্রকাশিত হয় তার স্বরচিত গ্রন্থ চরিতাবলী।
১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি স্থাপিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য তথা ফেলো মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়।
১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। ১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের সেক্রেটারি মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। ১৮৬৩ সালে সরকার তাকে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। ১৮৬৫ সালের ১১ জানুয়ারি ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর মহাশয় তার প্রথম রিপোর্টটি পেশ করেন। ১৮৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার নিকট আবেদনপত্র পাঠান বিদ্যাসাগর মহাশয়।
১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় এক হাজার টাকা দান করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। ১৮৭২ সালের ১৫ জুন হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড নামে একটি জনহিতকর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৮৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে স্থাপিত হয় মেট্রোপলিটান কলেজ। ১৮৭৪ সালে মাত্র এক বছরেই ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান কলেজ গুণানুসারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল।
১৮৭৫ সালের ৩১ মে নিজের উইল প্রস্তুত করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। পরের বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ডের ট্রাস্টি পদ থেকে ইস্তফা দেন।
১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয় সিআইই উপাধি পান। ১৮৮১ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ থেকে প্রথম বিএ পরীক্ষার্থী পাঠানো হয়।
১৮৮৫ সালে মেট্রোপলিটান কলেজের বউবাজার শাখা স্থাপিত হয়। ১৮৮৬ সালের অগস্টে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোসহচরস্য’ ছদ্মনামে রত্নপরীক্ষা পুস্তক প্রকাশ করেন। ১৮৮৭ সালের জানুয়ারিতে শঙ্কর ঘোষ লেনের নতুন ভবনে মেট্রোপলিটান কলেজ স্থানান্তরিত হয়। ১৮৮৮ সালের এপ্রিলে নিষ্কৃতিলাভ প্রয়াস, জুনে আখ্যান মঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ), জুলাইতে পদ্যসংগ্রহ নামক সংকলন গ্রন্থের প্রথম ভাগ প্রকাশ করেন।
১৮৩৯ সালে জ্ঞানচর্চায় তিনি 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
সংস্কৃত শাস্ত্রের বিরাট পণ্ডিত হয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণে দ্বিধা করেননি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন তিনি। হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাদের প্রতি পরিবারবর্গের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল তাকে। এই বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সর্বস্ব পণ করে সংগ্রাম করেছেন। হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন, যে লোকাচার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত, আসলে তা ধর্মবহির্ভূত স্থবিরতার আচারমাত্র। তার আন্দোলন সফল হয়েছিল। ১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন। তবে শুধু আইন প্রণয়নেই ক্ষান্ত থাকেননি বিদ্যাসাগর মহাশয়। তার উদ্যোগে একাধিক বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ। তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারীজাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতের প্রথম ভারতীয় বালিকা বিদ্যালয়।
বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ২৯ জুলাই, ১৮৯১ সালে তার কলকাতার বাদুড়বাগানস্থ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।