যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...
হ্যা প্রিয় পাঠক বৃন্দ, আর কখনই আমাদের সকলের প্রিয়জন এ্যাড. মঞ্জুরুল হকের পদ চিহ্ন পৃথিবীর বুকে পড়বে না। আকাশ ভরা অযুত নক্ষত্র থেকে একটি নক্ষত্র নিঃশব্দে খসে পড়ল মহাকালের অনন্ত যাত্রায়। আমাদের সকলের প্রাণের মানুষ মঞ্জুরুল হক ভাই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার এই আসা যাওয়ার মাঝখানে যে যাপিত জীবন, সেই বর্নাঢ্য জীবনের কিছু খন্ড চিত্র তুলে আনার আবেগময় প্রয়াস। তাকে পূর্ণাঙ্গ চিত্রিত করবার সাধ্য আমার নেই। শুধু তার সংস্পর্শ ও স্মৃতিময় অভিজ্ঞতার প্রকাশ করছি । তার সাথে সম্পর্ক অনেকের মত আমারও মোটা দাগে গুরু শিষ্য সুলভ। বয়সের ব্যবধান অনেক থাকা সত্ত্বেও মিশেছি গাঢ় বন্ধুত্বের মত। বিবর্তণ যশোরের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমৃত্যু তিনি প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। নব্বই দশকে আমরা এক ঝাক তরুণ সাম্যবাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এই সংগঠনের হাল ধরেছিলাম। যার প্রধান একটি সম্যস্যা ছিল জায়গা। বর্তমানের অফিসটির দখল ও ডিসিআর পেতে অনেক রক্তঘাম ঝরাতে হয়েছিল আমাদের। কয়েকটি কেস লড়তে হয়েছিল অনেক বড় বড় রাঘব বোয়ালদের সাথে। সেই কেসগুলো তিনি অত্যান্ত যত্নের সাথে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে আমাদের হয়ে লড়েছিলেন। সেই থেকেই তার সাথে আমার চেনা জানা। কখনও তাকে বিরক্ত হতে দেখিনি। সে জন্য অনেক প্রশ্ন করতে সাহস পেতাম । ভোর বেলা হাটতে হাটতে আমরা চলে গেছি ধর্মতলায় আকবর মিয়ার রড ফ্যাক্টরিতে। সেখান থেকে বড় বাজারে আব্বাস মিয়ার মাছের আড়ৎ এ বিবর্তনের নাট্য উৎসবের জন্য অর্থ কালেকশন করতে। সবাই যে সদয় হয়ে প্রকৃত সম্মান দিতেন তাও না। অনেকে উপেক্ষা করতো। তবুও তিনি হতাশ হতেন না আরো উৎসাহ দিতেন। চা বিস্কুট খাওয়াতেন নিজের পয়সায়। বলতেন “জুনিয়ার উইল এনজয়, সিনিয়র উইল পে”। তার কাছে জেনেছিলাম আমেরিকার বিখ্যাত এ্যানথ্রোপলোজিষ্ট লুই হেনরি মর্গান এর “ইস্পিসিজ” বইটির কথা এবং দুটি খন্ড কেনার জন্য আমাকে সহযোগিতাও করেছিলেন। আমার বোধে আসতো না একজন আইন পেশার মানুষ কিভাবে এত সাহিত্যরসিক হন। ইতিহাস জানেন, জানেন বর্তমান সমাজ সামাজিকতা । তার পান্ডিত্য আমরা তার সান্নিধ্যে থেকেও ঠিক ধরতে বা বুজতে পারিনি। দেখাতে পারিনি যোগ্য সম্মান। সে দৈন্যতা তিনি নিজ গুনে আমাদের ক্ষমা করবেন। কি রাজনৈতিক অঙ্গন, কি সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অঙ্গন, সমস্ত জায়গায় বিচরণ করেছেন স্বমহিমায়। কত শত স্মৃতি স্বল্প পরিসরে আনা অনেক কষ্টকর। শেষ কটি বছর, করোনা পরবর্তী ষ্ট্রোকের পর তার চলাফেরা সীমিত হয়ে আসে। আমি নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ায় তালতলা বাজার, সাদেক দারোগা মোড় এই সব রাস্তায় হাটার সাথী হবার চেষ্টা করতাম। যদি কিছু বেদবাক্য বা গুরু মন্ত্র পাই। তার ভেতরে অভিমান ছিল, ছিল তার সহকর্মীদের অবজ্ঞা ও অবহেলাও । যার জন্য তিনি বেশ চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। তার একটি কবিতা সংকলন আছে যেটা তার সাহিত্যরস প্রজ্ঞার নির্যাসের প্রকাশ। একদিন তিনি আমাদের কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতার একটি লাইন বোঝাচ্ছিলেন। “ পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে, বলেছিল বনলতা সেন”। বোঝালেন এই পাখির নীড়ের মত চোখ কবি কেন বললেন? যে চোখের চাহনিতে আশ্রয় আছে, প্রেম-ভালবাসা আছে। সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভাই ছিলেন অসংখ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের ত্রাতা। দেওয়ানী মামলা মোকদ্দমায় তার জীবদ্দশায় তিনি সেরাদের সেরা। তিনি এজলাসে হয়ে উঠতেন শেক্সপিয়র,মাক্সিম গোর্কী, রবীন্দ্রনাথ, দ্রোহী মাইকেল অথবা নজরুলের কাব্যের কোন চরিত্র। ছিলেন সুমিষ্ট ভাষী ও মনোমুগ্ধকর বাগ্মী। সর্বদা মৃদু হাসি ও মিষ্টভাষী । কোনো দলীয় পরিচয় ছাড়াই তিনি জিপি হিসাবে দীর্ঘদিন সরকারী প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক রাজনৈতিক দলের অফিসের কেস, ছাত্র নেতাদের জেল জুলুম হয়রানীর মামলা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কেস, অনেক সামাজিক সেবা মূলক সংগঠনের কেস তিনি লড়েছেন যোগ্যতার সাথে। এভাবেই তিনি সাবার কাছে হয়ে উঠেছেন অন্ধের যষ্ঠির মত। কখনও তাকে দল কানা হতে দেখিনি। আইন পেশার সাথে নানা রকম নেগেটিভ এ্যাপ্রোজ থাকে মক্কেলের সাথে। কিন্তু তার অবস্থান ছিল এ সমস্ত কিছুর থেকে অনেক উপরে। তিনি বলতেন এক জন ডাক্তারের কাছে যেমন কোন অসুস্থ ব্যাক্তি মাত্রই রোগী। তার কাছে পেশাটাও তেমনি, সে যেমন লোকই হোক তার আইনি সহায়তা পাবার অধিকার আছে একজন উকিলের কাছে। তার সুতীক্ষè বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনা ছিল যেন ধন্মন্তরী। যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই ফলেছে সোনা। আমারা নব্বই এর দশকে বিবর্তনের নাটকের টিম নিয়ে চলেছি কোলকাতায়, সেখানে তিনি আমাদের মধ্যমনি। ভাইয়ের সাথে মিশতে আমাদের একটুও অসুবিধা হতোনা বয়সের ব্যবধান সত্বেও। যেমন ছিল প্রগাড় বন্ধুত্ত্ব তেমনই ছিল মাত্রা জ্ঞান। অসংখ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন তার মধ্যে যশোর ক্লাব, রোটারী ক্লাব, বিবর্তণ যশোর, উদীচী, পুনশ্চ সহ আরো অনেক সংগঠনের সাথে সবার কথা হয়তো এখানে আসলো না তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ছিল তার একটা সম্মান জনক সম্বন্ধ ও অবস্থান। ছিলেন আজীবন প্রগতিশীলতার সাথে। নড়াইল শহরে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা তাই ইতনায় যেতেন প্রায়ই।
সমাজ কর্মী, সংবাদ কর্মী সকল স্তরেই ছিল তার অভিভাবক ও বন্ধুত্ত্ব সুলভ বিচরণ। তিনি লেখা লেখিতেও ছিলেন সমান পারঙ্গম। যারা একটু পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী তিনি তাদের সাথে অতি দ্রুত আড্ডা জমাতে পারতেন। তার বাসা, বিছানা, সিথানে সমসময় বই ছিটানো থাকতো। ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে অসম্ভব দুষ্প্রাপ্য বই। তার দুই মেয়ে থাকেন প্রবাসে। তারা তাকে নিতে পারেনি । তাঁর এই আকষ্মিক মৃত্যু আমাদের ব্যাথিত করে। তার ছোট মেয়ে কাকলি সেও একই দিনে মারা গেছে কানাডা প্রবাসে। সেই সংবাদটিও উনি জেনে যেতে পারেন নি। হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে তার বড় ছেলে এ্যাড. সোহেল শামীমের কোলেই শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। আমরা যশোরবাসী হারালাম অভিভাবক। তার এই চলে যাওয়া প্রস্থান নয়। নতুন ভাবে নতুন ভাবনায়, নতুন কোন আলোচনায় তিনি থাকবেন আমাদের মাঝে চির জাগ্রত।