শিরোনাম |
আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন। বেঁচে থাকার জন্য পানি বায়ু খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এর জন্য আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করা বান্দার আবশ্যকীয় কাজ। পাশাপাশি যে পরিবারে আমরা জন্মেছি, যে সমাজে বসবাস করছি, যে সমাজব্যবস্থায় বেড়ে উঠেছি; সে সমাজের প্রতিও কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা মোতাবেক আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। দেশপ্রেমের মতো সমাজসেবা বা পরোপকারও ইমানের একটি অপরিহার্য অংশ। কিছু কিছু ইবাদত শুধু আল্লাহর জন্য সুনির্দিষ্ট যা শুধু আল্লাহর জন্যই সরাসরি করতে হয়। যেমন- সিজদা, নামাজ, রোজা, হজ, কোরআন তেলাওয়াত প্রভৃতি।
কিছু মানুষ আছে, যারা অন্যদের কাছে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। নিয়মিত নামাজ পড়ে, দ্বিনদার, ধার্মিক, আলেম কিংবা আল্লাহওয়ালা হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। প্রকাশ্যে তাকে পাপ কাজ করতে দেখা যায় না। কিন্তু গোপনে গোপনে তিনি নানা ধরনের গোনাহের কাজে লিপ্ত থাকেন।
অনেকে তো প্রকাশ্যে ভালো মানুষ হলেও গোপনে কবিরা গোনাহ করে। এটি একদিকে মুনাফেকি, অন্যদিকে ধীরে ধীরে তার আমল ও ইবাদত নষ্ট করে দেয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন পাপ বর্জন করো, যারা পাপ করে, অচিরেই তাদের পাপের সমুচিত শাস্তি দেওয়া হবে।
মুমিন বান্দা পাপ থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু পাপের অনুকূল পরিবেশ, অসৎ সঙ্গের প্রভাব ও শয়তানের সার্বক্ষণিক প্ররোচনায় পাপমুক্ত থাকা সম্ভব হয় না। যদি কোরআন-সুন্নাহর আলোকে কিছু উপায় অবলম্বন করা যায়, তাহলে অধিক পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচা যেতে পারে।
গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য অনেকগুলো উপায় থাকলেও এর মধ্য থেকে সহজ কয়েকটি উপায় তুলে ধরা হলো:
১. গুনাহের পথ বন্ধ করে দেয়া : কোনো গুনাহের কাজ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে দ্রুত তা থেকে ফিরে আসা। কারণ আমাদের সমাজে সাধারণত চলতে গেলে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের গুনাহের সম্মুখীন হতে হয়। তাই আমরা যদি এসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে চাই তবে আমাদেরকে গুনাহের পথসমূহকে বন্ধ করে দিতে হবে।
আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ আছে, “খাল কেটে কুমির কুমির আনা।”
কিন্ত গুনাহের ক্ষেত্রে, এমন করা যাবে না অর্থাৎ কুমির আসার সম্ভাবনা থাকলে খাল কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে।
২. দৃষ্টিকে সংযত রাখা : মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনুল কারীমে ব্যাভিচারকে নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, “তোমরা জিনার ধারে কাছেও যেয়ো না। কারণ এটি একটি লজ্জাজনক ও নিকৃষ্ট কর্ম, যা অন্যান্য নিকৃষ্ট কর্মের পথ খুলে দেয়।”(সূরা আল ইসরা : ৩২)
আমরা জানি, ব্যাভিচারের দ্বার উন্মুক্ত করে দৃষ্টি। প্রথমে চোখ দিয়ে মানুষ কাউকে দেখে। পছন্দ হলে তাকে মন থেকে অনুভব করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত হয়।
তাই ব্যাভিচার থেকে বাঁচতে হলে আগে আমাদের চোখকে সংযত করতে হবে। এটিতে সক্ষম হলে ব্যাভিচারের পথও বন্ধ হয়ে যাবে।
৩. গোপন অভিসার থেকে দূরে থাকা : যাদের সঙ্গে নারী-পুরুষের বিবাহ অবৈধ তারা ছাড়া বাকি সবার সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারণ যাদেরকে বিবাহ করা বৈধ সেসব পুরুষ ও নারী নির্জনে মিলিত হলে সেখানে তৃতীয় আরেকজন থাকে এবং সে হচ্ছে শয়তান। সুতরাং সেই পথটি বন্ধ করা প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। এখানে ফাঁক-ফোকর খোঁজার চেষ্টা সুবিধাবাদীদের অপচেষ্টামাত্র।
মূলত শয়তানকে কোনোভাবেই সুযোগ দেয়া যাবে না। এমনটা করলে সে আমাদেরকে হারামের পথেই নিয়ে যাবে।
ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “যখনই কোনো পুরুষ পরনারীর সঙ্গে নির্জনে দেখা করে তখনই শয়তান সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত হয়।” (তিরমিযী : ২১৬৫; ইবনে হিব্বান : ৫৫৮৬)
৪. ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্ক থাকা : আজকের পৃথিবীর অন্যতম জীবন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট। এখানে যেমন রয়েছে ভালো ও উপকারী বিষয় তেমনি রয়েছে মন্দ ও অশ্লীলতা। আমরা ভালোকে গ্রহণ করে মন্দগুলো থেকে নিজেকে সংযত রাখতে পারলেই মানুষ পাপকর্ম থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হবে।
৫. সালাত আদায় করা : নামাজ মানুষকে অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখে। তাই যথাসম্ভব নামাজ আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা অবশ্য কর্তব্য। এর সঙ্গে প্রাত্যহিক রুটিনের একটি বিষয় রয়েছে। কারণ আমরা যদি প্রতিদিনের রুটিন ঠিক নেই তবে সঠিক সময়ে নামাজ আদায় করতে পারবো।
আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত, নবী করিম (সা.) মুনাফিকের জন্য ফজর আর এশার সলাত যত কষ্টকর অন্য আর কোন সলাত অনুরূপ কষ্টকর নয়, তারা যদি এ দুটি সালাতের সওয়াব সম্পর্কে জানতো, তাহলে নিতম্বে ভর করে হলেও এ দুই সালাতে উপস্থিত হতো। (বুখারী : ৫৮০)
রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ফজরের সলাত জামাতে আদায় করে, সে আল্লাহর জিম্মায়-দায়িত্বেই থাকে, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মা-দায়িত্ব বিনষ্ট করে আল্লাহ তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (তিবরানী)
৬. আল্লাহর ভয় অন্তরে লালন করা : কুরআন ও হাদিসের পরিভাষায় এ ভয়কে তাকওয়া বলা হয়। তাকওয়া বা আন্তরিকতাবিহীন কোনো কাজই সফলতা বয়ে আনে না। যেকোনো কাজের প্রাণ হল তাকওয়া। বিশেষ করে ইবাদত হিসাবে যা কিছু করা হয় তা আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হওয়ার জন্য তাকওয়া একান্ত প্রয়োজন।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বান্দা যখন কোনো গোনাহর কাজ করে তখন তার অন্তরে এক ধরনের কালো দাগ পড়ে যায়। যদি ইস্তেগফার করে তাহলে এই দাগ দূরীভূত করে তার অন্তর সুচালু, ধারালো ও পরিশীলিত হয়। আর এই দাগের কথা কুরআনেই আছে, খবরদার! তাদের অন্তরে দাগ রয়েছে যা তারা কামাই করেছে। (তিরমিজি, ৫ খ. : ৩৩৩৪)
গুনাহ সম্পর্কে জানা উচিত সেটা ছোট বা বড় (সগীরা বা কবীরা) যা-ই হোক না কেন এবং সর্বদা চেষ্টা করতে হবে ছোট ছোট গুনাহ থেকেও বেঁচে থাকার জন্য।
পাপ করলে যেসব ক্ষতি হতে পারে : ইবনুল কাইয়্যিম আল-জওযিয়্যাহ (র.) তার প্রণীত ‘আদ-দা ওয়াদ দাওয়া’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, গুনাহর ক্ষতি অনেক। নিম্নে এর কয়েকটি বর্ণনা করা হলো।
ক. জ্ঞান থেকে বঞ্চনা।
খ. ইবাদত-আনুগত্য থেকে বঞ্চনা।
গ. নেক কাজের সৌভাগ্য কমে যাওয়া।
ঘ. গুনাহকারীর মর্যাদাহানি হওয়া।
ঙ. মন থেকে লজ্জা চলে যাওয়া।
চ. বরকত চলে যাওয়া।
ছ. বক্ষ সংকুচিত হওয়া।
জ. অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়া।
ঝ. লাঞ্ছনার শিকার হওয়া।
ঞ. অশুভ পরিণতি নেমে আসা।
ট. আখেরাতে আযাবের সম্মুখীন হওয়া।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ আরো বলেন, “প্রতিটি পাপ আরো অনেক পাপের জন্ম দেয়, একটি পাপ আরেকটি পাপের দিকে নিয়ে যেতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই পাপরাশি মানুষটিকে এমনভাবে কাবু করে ফেলে যে কৃত পাপগুলোর জন্য তাওবা করাকে তার কাছে কঠিন বলে মনে হয়।”
তিনি আরো বলেন, একজন পাপাচারী লোক তার পাপের জন্য অনুতপ্ত হয় না। কারণ তার অন্তর ইতোমধ্যেই মরে গেছে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, পাপ হলো শেকলের মতন যা পাপকারীকে আটকে রাখে যেন সে তাওহীদের বিশাল বাগানে বিচরণ করতে এবং সেখানকার ফল সৎকর্মসমূহকে সংগ্রহ করতে না পারে। (মাজমুল ফাতাওয়া : ১৪/৪৯)
আল্লাহ আমাদের যেসব গুনাহকে গোপন করেছেন তথা মানুষের কাছ থেকে আড়াল করেছেন সে সমস্ত গুনাহর কথা জনে জনে বলে বেড়ানো অবশ্যই ঠিক হবে না। কেননা এতে নিজের মর্যাদার সাথে সাথে আল্লাহ্র মর্যাদাও ক্ষুন্ন করা হবে।
এছাড়া আরো বহু পথ ও পন্থা রয়েছে নিজেকে গোনাহের কাজ বিরত রাখার। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সেসব থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।