শিরোনাম |
তিব্বতের তাংগুলা পর্বতমালার বরফগলা পানি থেকে জন্ম নিয়েছে চীনের তথা এশিয়ার সবচেয়ে বড় নদী। পশ্চিমারা একে ইয়াংৎসি নামে ডাকে, যার অর্থ ‘সমুদ্রের সন্তান’। তবে চীনাদের কাছে এই নদীর নাম ছাং চিয়াং, যার অর্থ ‘বড় নদী’। সাংহাই শহরের কাছে পূর্ব চীন সাগরে মিলিত হওয়ার আগে এ নদী পাড়ি দিয়েছে প্রায় ৬,৩০০ কিলোমিটার। নীলনদ ও আমাজন নদীর পর এটি বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী। যেকোনো দেশের মধ্য দিয়ে পাড়ি দেওয়া সবচেয়ে বড় নদীও এটি। নদীটির মাঝামাঝি অংশে আছে তিন গিরিসঙ্কট। কিউট্যাং, উ এবং শিলিং শিয়া। এই শিলিং গিরিসঙ্কটেই নির্মাণ করা হয়েছে পৃথিবী কাঁপানো ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’ বা তিন গিরিসঙ্কটের বাঁধ।
এই বাঁধটির উচ্চতা ১৮৫ মিটার। অর্থাৎ প্রায় ৬০ তলা ভবনের সমান উঁচু এই বাঁধটি। প্রস্থ প্রায় ২ হাজার ৩০৯ মিটার। এটিই বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ। এই বাঁধের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২২,৫০০ মেগাওয়াট। মহাকাশ থেকে খালি চোখে দেখা যায়, এমন মানবসৃষ্ট স্থাপনাগুলোর মধ্যে ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’ একটি। মহাপ্রাচীরের পর এটিই চীনের সবচেয়ে বড় স্থাপনা। চল্লিশ হাজার শ্রমিক নিয়মিত কাজ চালিয়ে ১৭ বছর ধরে নির্মাণ করেছে চীনের থ্রি গর্জেস ড্যাম।
১৯৯৪ সালে এই মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১১ সালে চালু করা হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ড্যাম। ৩১ মিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে চীন তৈরি করেছে এই বাঁধ। ২০০৫ সালে আমেরিকার গবেষণা সংস্থা নাসা জানায়, থ্রি গর্জিয়াস ড্যামের বিপুল জলরাশির চাপে আগের চেয়ে কিছুটা নিচু হয়ে গেছে পৃথিবী। শুধু তাই না এই বাঁধের কারণে পৃথিবীর মাঝের অংশ সামান্য ফুলে উঠেছে। এ ছাড়া পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চল চেপে গিয়েছে। ড্যামে আটকে থাকা বিপুল পানির চাপে বদল এসেছে পৃথিবীর আহ্নিক গতির বেগে। ফলে দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে।
এটি দেশটির জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে এবং নেতৃত্ব দিতে চীন যে কয়টি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে এই বাঁধ নির্মাণ তার মধ্যে অন্যতম। থ্রি গর্জেস ড্যাম পৃথিবীর আহ্নিক গতি থেকে শুরু করে পৃথিবীর আকৃতিতে পরিবর্তন এনেছে।
এশিয়ার সবচেয়ে বড় নদী ইয়াসি। চীনের পশ্চিম অঞ্চলের পাহাড় বেষ্টিত এই নদী প্রায় পুরো চীনের ভেতর দিয়ে এসে পতিত হয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরে। জানা যায়, ১৯১১ সালে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ইয়াংসি নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। ফলে সৃষ্টি হয় এক ভয়ংকর বন্যা। সে বন্যার প্রভাবে মৃত্যু হয়েছিল কমপক্ষে দুই লাখ মানুষের। ঘরবাড়ি হারিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। ১৯৩১ সালে চীনে আবারও এক ভয়ংকর বন্যা দেখা দেয়। এই বন্যার প্রভাব ছিল আরও ভয়াবহ। বন্যাকবলিত হয়ে মৃত্যু হয় প্রায় ৩০ লাখ মানুষের। বন্যার কবল থেকে দেশ এবং দেশের মানুষকে বাঁচাতে এই ব্যায়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় চীনা সরকার। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়।
২ কোটি আশি লাখ ইউরিক মিটার কংক্রিট ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই পরিমাণ কংক্রিট যদি সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে একবার ঢেলে দেওয়া যেত তাহলে দুই ফিট কংক্রিটের নিচে ডুবে যেত সমগ্র সুইজারল্যান্ড। এই ড্যাম এতো পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করে যে এর ফলে পৃথিবী ধীরে ঘুরতে শুরু করেছে। ০.০৬ মাইক্রো সেকেন্ড পর্যন্ত ধীর হওয়ায় পুরো পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য ০.০৬ মাইক্রো সেকেন্ড বেড়ে গেছে।
চীনের খরা মোকাবিলার প্রয়োজন হলে থ্রি গর্জেস ড্যামের তিনটি জলাধার খুলে দেয়। এই বাঁধের ফলে চীন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা মোকাবিলা করতে পারছে। একই সঙ্গে বিশাল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যাচ্ছে।