শিরোনাম |
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সঠিক তদন্তপূর্বক প্রতিটা হত্যাকা-ের বিচার দাবি করছি। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসকারীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। প্রাণহানী এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংসর কোনটাই কাম্য নয়। কিন্তু অনাকাক্সিক্ষতভাবে সেটাই ঘটে গেল।
কোটা আন্দোলনে যতই দিন গড়াচ্ছিল ততই আশঙ্কা হচ্ছিল সুযোগ সন্ধানী স্বার্থান্বেষী মহল তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে এই আন্দোলনে ঢুকে পড়তে পারে। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কা ভয়ঙ্কররূপে সত্যি হয়ে দেখা দিল। সম্পদহানীর ক্ষতি হয়ত একদিন পোষানো যাবে, যদিও এর ধাক্কা সামলাতে অনেক দিন লাগবে। কিন্তু প্রাণহানীর ক্ষতি কোনোদিনও পুষিয়ে নেওয়া যাবে না। অথচ সময়মত উভয় পক্ষ একটু বিচক্ষণতার পরিচয় দিলে হয়ত তৃতীয় পক্ষের অনুপ্রবেশ এবং এই ভয়াবহ ক্ষতি এড়ানো যেত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটানো এবং উস্কানি প্রদান পরিস্থিতিকে আরো অবনতির দিকে নিয়ে গেছে। অনেক দায়িত্বশীল মানুষও এই গুজব ও উস্কানিতে অংশ নেয়। তাদেরকে দেখেছি একতরফা পোস্ট দিতে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু কিছু ভিডিও ক্লিপ পোস্ট দেওয়া হয়েছে বা এখনো হচ্ছে যাতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আরো ইমোশনাল হয়ে পড়ে। রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র ছাত্র আবু সাইদের হত্যাকান্ড যেমন জঘন্য, নিন্দনীয়, তেমনই যাত্রাবাড়ি ও গাজিপুরে দু’জনকে পিটিয়ে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখাও বর্বরোচিত। অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসকারীদের এবং এর মদদদাতাদের নিন্দা জানানো এবং শাস্তি দাবি করাও প্রতিটা সচেতন নাগরিকের কর্তব্য। কিন্তু আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একপেশে পোস্ট দেখছি। তাও আবার অতিরঞ্জিতভাবে। এতে করে কোটা আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্রসমাজ বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং তারা অতিমাত্রায় আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছে।
তবে শিক্ষার্থীদের এখন উপলব্ধি করা উচিত, তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মারা ঢুকে সারাদেশে অবর্ণনীয় তা-ব চালিয়েছে এবং অনেক নিরীহ মানুষ হত্যায় তারাও জড়িত। ফলে তাদের প্ররোচনায় আর সাড়া দেওয়া উচিত নয়। শিক্ষার্থীদের মূল দাবি-কোটা সংস্কার পূরণ হয়েছে। তারপরও তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এখন নয় দফা দাবিতে তারা আন্দোলন করছে তার মধ্যে মূল হলো-হত্যাকা-ের বিচার। সারা দেশবাসী বিচার চায়। কিন্তু এটা কি রাতারাতি সম্ভব? এর জন্যে তো একটা প্রক্রিয়া আছে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাওয়া হয়েছে, সেটা চলছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল, অপরাধী চিহ্নিতকরণ, গ্রেফতার, চার্জশিট প্রদান, আদালতে শুনানী তারপরে তো বিচারের রায়। এসব প্রক্রিয়ার জন্যে তো ন্যূনতম একটা সময় প্রয়োজন। সে সময়টা কি আন্দোলনকারীরা সরকারকে দেবে না? যত আন্দোলন তত সংঘাত-সংঘর্ষ এবং ততই হতাহতের আশঙ্কা। আন্দোলন আবার বিস্তৃত হওয়ার পূর্বেই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ আন্দোলনকারীদের সাথে সরাসরি কথা বললে দেশের জন্য মঙ্গল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটনা, অপপ্রচার আর উস্কানীর বিপরীতে সঠিক ও সত্য প্রচার যথেষ্ট নয়। এই দায়িত্বটা যাদের বেশি অর্থাৎ সরকারি দল ও তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা (হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া) রহস্যজনক কারণে নীরব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা সর্বদা সক্রিয় থাকেন, প্রয়োজনের সময় তারাও নিশ্চুপ। আবার তারা সশরীরেও মাঠে নেই। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা হয়ত আবেগতাড়িত। কিন্তু তাদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলা যেতে পারে। গণসংযোগ কারা যেতে পারে। কিন্তু অধিকাংশই কেন যেন গা বাঁচিয়ে চলছেন।
কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয়েছে, নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগই কেন যেন আওয়ামী বিরোধী। আওয়ামী লীগ সবচেয়ে প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি ক্লাসে মুক্তিযুদ্ধের বিস্তারিত ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের নানা দিক পড়ানো হচ্ছে, প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্ণার রয়েছে, জাতীয় দিবসগুলি পালনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তারপরও এই প্রজন্ম কেন আওয়মী লীগের প্রতি বিমুখ? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা যে সংখ্যায় একুশের প্রভাতফেরিতে বা স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের র্যালিতে অংশ নিতাম, এখনকার শিক্ষার্থীরা তার একশ ভাগের এক ভাগও অংশ নেয় না। এর কারণ কী? আমার নিজস্ব ধারণা, আমরা অনেক কিছু এদের উপর চাপিয়ে দিই-যা এরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে না। তাছাড়া রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্তা ব্যক্তিদের ঘুষ-দুর্নীতির খবর যেভাবে প্রকাশিত হচ্ছে তাতে সরকারের প্রতি শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিভিন্ন অফিস আদালতে গিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির মুখোমুখি হয় এবং বাড়িতে গিয়ে যখন তারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা ছেলেমেয়েদের সামনে বলে তখন সরকারের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠে। এছাড়া স্থানীয় হাইব্রিড নেতাদের দ্বারা ভূমি দখল, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, পেশিশক্তি প্রদর্শন ইত্যাদি কর্মকান্ড কেউ ভালোভাবে নেয় না। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া এতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও তার অতীত গৌরব হারিয়েছে।
ছাত্র সংগঠনের কাজ হলো সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করা। তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার থাকা, তাদের বিপদে আপদে পাশে থাকা, নিরপত্তা দেওয়া। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে তাদের থাকবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমি নিজেও ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছি। শুরুতে বড় ভাইয়েরা বলতেন, “বেশি করে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মিশবে, তাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলবে, তাদের সুবিধা-অসুবিধা মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং সেগুলো সমাধানের চেষ্ট করবে। নিজেরা না পারলে আমাদের কাছে আসবে।” আমরা সেটাই করেছি। কিন্তু এখন এর বিপরীত চিত্রই লক্ষণীয়। ছাত্রনেতারা এখন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, সিট দখল, ছাত্র নিপীড়ন, পেশিশক্তি প্রদর্শন ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত। এসব কারণে এখনকার শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়েছে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্র সংগঠনের নেতাদের উপর আস্থা বা ভরসা রাখতে পারে না। অবশ্য বিএনপি-জামায়েত আমলে ঘুষ-দুর্নীতি, মাস্তানি বেশি হয়েছে। দুর্নীতিতে দেশ পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বর্বরোচিত সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে, কুখ্যাত হাওয়া ভবনের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মতো সেগুলি দেখেনি। তাই তারা কমপেয়ার করতে পারে না। তারা চোখের সামনে যা দেখছে তাকেই সত্য বলে জানচ্ছে।
নীতি নির্ধারকরা যদি এসব বিষয়ে না ভাবেন এবং যুগোপযোগী বাস্তব সম্মত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন, তাহলে নব প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নেবে।
# লেখকঃ প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট