শিরোনাম |
❒ কুয়াকাটা সৈকত রক্ষার কাজ
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যটনকেন্দ্র পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। কুয়াকাটা ভ্রমণবিলাসী মানুষের কাছে পছন্দের একটি স্থান। বিশেষ করে কুয়াকাটাসংলগ্ন ফাতরার চর বা টেংরাগিরি বনাঞ্চল, সমুদ্রের নিঃসীম জলরাশি, জেলেদের মাছ ধরার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এবং একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করতে সবার ভালো লাগে। এসব কারণে কুয়াকাটায় ছুটে আসছেন দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় পর্যটকের সংখ্যা আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে। তবে সমুদ্রের অব্যাহত ভাঙন এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে আকর্ষণীয় স্থানটি দিন দিন শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভ্রমণপিপাসু মানুষরা এর নাম দিয়েছেন সাগরকন্যা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মতো বিরল এই সৌন্দর্য ভূমি উপভোগ করতে এখানে আসেন প্রতি দিন শত শত মানুষ। সৈকতের বেলাভূমি রক্ষায় উদাসীন কর্তৃপক্ষ।
দেড় দশক ধরে পরিদর্শন আর আশ্বাসে আটকে আছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা সৈকতের ভাঙন রোধের কাজ। এতে দীর্ঘ বেলাভূমি প্রতি বছর প্রস্থতা হারাতে হারাতে হচ্ছে সংকুচিত। সাগরে বিলীন হচ্ছে নতুন নতুন স্থাপনা। বেলা ভূমি জুড়ে বিশাল সবুজ বেষ্টনী হচ্ছে উজাড়। সৈকতের বালু ধুয়ে যাওয়ায় সৈকত কোথাও নিচু, কোথাও উঁচু এবং জিও ব্যাগের এলো-মেলো রয়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও ছোট-বড় গর্ত দেখা দিয়েছে। সেসব গর্তে পানি জমে থাকায় পর্যটকদের চলাচলে ভোগান্তি আরও বেড়েছে প্রতিদিন জেয়ারের সময় আহত ঘটনা। পর্যটন কেন্দ্রীক ব্যবসায়ীসহ সেবা খাতের লোকজন কুয়াকাটা সৈকত ও এর বেলাভূমি রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
এখনই স্থায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলা না হলে জৌলুশ হারিয়ে শ্রীহীন কুয়াকাটা হারাতে পারে পর্যটকদের আকর্ষণ। বিনিয়োগকারীসহ ব্যবসায়ীদের শঙ্কা, স্থায়ী উদ্যোগ না নিলে হুমকির মুখে পড়বে কুয়াকাটা পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ।
বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র সৈকতের গতিধারা বদলে গেছে। ফলে গত দেড় দশক ধরে তীব্র ¯্রােত আর উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে অব্যাহত বালুক্ষয়ে কুয়াকাটা সৈকত হারিয়েছে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থতা। সাগরে বিলীন হয়েছে নারিকেল বাগান, ঝাউ বাগান, ইকোপার্ক, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীসহ কয়েকশ স্থাপনা।
সম্প্রতি অমাবস্যা জো'য়ের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে উত্তাল ঢেউয়ের তান্ডবে সৈকতের প্রশÍতা হয়েছে আরও সংকুচিত। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রতটজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এর ক্ষতচিহ্ন। যেকোনো সময় বিলীন হতে পারে কেন্দ্রীয় ঘাটলা মসজিদ, মাদ্রাসা, রাধাকৃষ্ণ সেবাশ্রম, ট্যুরিজম পার্ক, দুই শতাধিক স্থাপনা, সবুজ বনভূমির অবশিষ্টাংশ, অর্ধশতাধিক আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, শুঁটকি ও ঝিনুক মার্কেটসহ বহুমুখী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে সৈকতের ভূভাগে। প্রচন্ড ঢেউয়ের ঝাপটায় সৈকতের বালু সরে সমুদ্র গহ্বরে চলে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সমুদ্র গর্ভে চলে গেছে কয়েক হাজার একর বনভূমিসহ ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান। ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে রাজস্ব বোর্ডের বাংলো, এলজিইডির বায়োগ্যাস প্লান্ট, পাবলিক টয়লেট, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘরসহ হাজার হাজার একর ফসলি জমি। বাপাউবোর তথ্যমতে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ১ মিটার করে সৈকত ঢেউয়ের ঝাপটায় বিলীন হয়ে সমুদ্র গর্ভে চলে যাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় ৭৫৯ কোটি টাকা একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে পাউবো। প্রকল্প অনুমোদন হয়ে কবে নাগাদ ওই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে, তা পাউবো নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি।
পটুয়াখালী বন বিভাগ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে কুয়াকাটা সৈকতে ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ইকোপার্কও গড়ে তোলে। এ পার্কে পিকনিক শেড, দৃষ্টিনন্দন কাঠের ব্রিজ, কালভার্ট, মাটির রাস্তাাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। রোপণ করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির ৪২ হাজার গাছ। তবে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এ পার্কেও এক-তৃতীংশ বিলীন হয়েছে।
পটুয়াখালী বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, কুয়াকাটা সৈকতে একসময় ৩ হাজার ৩৮৭ একর বনভূমি থাকলেও এখন মাত্র ১ হাজার ৩০০ একর অবশিষ্ট আছে। বাকি প্রায় দুই হাজার একর বিলীন হয়ে গেছে।
স্থানীয়রাসহ ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ষা মৌসুমে বাড়ে ভাঙনের তীব্রতা। পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধু মাত্র জিরো পয়েন্ট এলাকায় মাত্র কয়েকশ ফুট ভাঙন প্রতিরোধে সাময়িক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগ কোনো কাজেই আসছে না।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকার বাসিন্দা মো. বাচ্চু বলেন, গত চার দশকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভূভাগ ও বনাঞ্চল ভাঙনে সমুদ্রে গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে সমুদ্রের পাড়ে যেতে এক দুপুর সময় লাগত। সমুদ্র ভাঙতে ভাঙতে এখন বাড়িঘরের কাছে এসে গেছে।
সৈকত এলাকার বাসিন্দা মোসা. রাবেয়া বেগম বলেন, জীবন-যৌবন সমুদ্রের পাড়েই কেটেছে তার। ফয়েজ মিয়ার বাগান পেরিয়ে খাল, নালা, রিজার্ভ ফরেস্ট তারপর ছিল সমুদ্র । বাড়ি থেকে সমুদ্রের পাড়ে যেতে ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগত। ভাঙতে ভাঙতে এখন সমুদ্র কাছে এসে গেছে।
গনমাধ্যম কর্মী ও কুয়াকাটা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মো. নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, পানি উন্নয়ন র্বোড সম্ভবনা যাচাই-বাচাই করতে বছরের পর বছর পার করছে। কোটি কোটি টাকা সৈকত রক্ষা ডালতে আছে। কোনো কাজে আসতে আছে না। পানি উন্নয়ন র্বোডের কাজের মধ্যে রয়েছে বিশাল ফাঁক-যোগ। এ কাজটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে করানো উচিত আমি মনে করি।
হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মোতালেব শরীফ বলেন, কুয়াকাটা পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে হুমকির মুখে। বন্ধ হয়ে আছে সব ধরনের বিনিয়োগ। মেরিন ড্রেইপ বীচ প্রক্টোকশন আজকে-কালকে করি এভাবে বছরের পর বছর পার হতে চলছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রাকিব হোসেন বলেন, সাত শত ৫৯ কোটি টাকা পরিকল্পনা অনুমোদনের প্রকৃয়াধীন রয়েছে। তা বরাদ্ধ হলে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষার কাজ শুরু করা হবে বলে তিনি জানান।
কুয়াকাটা পৌর মেয়র মো.আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় জিওব্যাগ দেওয়া গত রিমালের প্রভাব থেকে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা পেয়েছে। সামনে বর্ষা মওসুম এখন ও যদি সৈকতকে রক্ষা করা না যায় তা হলে আর ক্ষতি হবে। সৈকত রক্ষার আজকে-কালকে করি এভাবে বছরের পর বছর পার হতে চলছে।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.রবিউল ইসলাম বলেন, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় পানি উন্নয়ন র্বোডের সাথে আলোচনা হয়েছে। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে ধুলাসার ১২ কিলোমিটার মেরিন ড্রেইপ ডিউলেটার দেওয়া হয়েছে ও ত্রান ও দুর্যোগ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীর সাথে আলোচনা হয়েছে।