শিরোনাম |
ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাঙালি অভিনেত্রী ও কণ্ঠশিল্পী কানন দেবীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। অতি সামান্য অবস্থা থেকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে কিংবদন্তি গায়িকা-নায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অন্যের বাসায় বাসন মেজে, ঝিগিরি করে যাকে একসময়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে, কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে, তিনিই হয়ে উঠেছেন পরবর্তীকালে বাংলা সিনেমার ও সংগীতের সম্রাজ্ঞী ‘কাননবালা দেবী’। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম কাননবালা দেবী প্রথম বাঙালি অভিনেত্রী হিসেবে প্রথম দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার অর্জন করেন।
কানন দেবী ২২ এপ্রিল, ১৯১৬ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়াতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম রতন চন্দ্র দাস এবং মায়ের নাম রাজবালা দেবী। তবে রাজবালা ছিলেন রতন চন্দ্র দাসের রক্ষিতা।
কাননদেবীর পাঁচ বৎসর বয়সে পিতার মৃত্যু হয়। রাজবালা তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে দুর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাড়িতে রাধুনী ও ঝি-এর কাজ করতেন। এই সময় এঁরা থাকতেন, হাওড়ার ঘোলডাঙা বস্তিতে। সেখানে তাঁর মতো অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে নিয়ে সম্মানের সাথে থাকাটা মুশকিল হয়ে পড়ে। রাজবালা চান নি যে, তাঁর মেয়েও কারো রক্ষিতা হোক। শেষ পর্যন্ত অভাবের কারণে, ১৯২৬ সালে তাঁর মা তাঁকে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার অনুমতি দেন। এই সূত্রে ম্যাডান থিয়েটার্সের-এর ব্যানারে নির্মিত ' জয়দেব' নামক নির্বাক ছবিতে একটি অল্প বয়সী মেয়ে 'শ্রীরাধা' নামক চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ছবির পরিচালক ছিলেন জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অভিনয়ের জন্য তিনি সম্মানী পেয়েছিলেন মাত্র ৫ টাকা। এই সময় তাঁর নামকরণ হয় 'কাননবালা'। এরপর তিনি ম্যাডান থিয়েটার্স-এর 'ঋষির প্রেম', 'প্রহ্লাদ' ছবিতে অভিনয় করেন।
কাননদেবী যখন চলচ্চিত্রে আসেন, তখন অভিজাত ঘরের মেয়েরা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আসতেন না। এমনিতে কাননবালা ছিলে অভাবী ঘরের, অন্য দিকে ছিলেন রক্ষিতার কন্যা। এই কারণে, তাঁর সামাজিক মূল্য ছিল অতি নিম্নস্তরের। চলচ্চিত্রে আসার পর, তাঁর এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। পরিচালকরা তাঁকে দিয়ে প্রায় নগ্নদশায় পর্দায় উপস্থিত করার চেষ্টা করেন। শোনা যায়, ছবি নির্মাতারা তাঁকে অভিনয়ের সম্মানীও ঠিক মতো দেন না।
বহু প্রতিভার কানন দেবী অভিনয়ের পাশাপাশি নৃত্য এবং সঙ্গীতেও ছিলেন পারদর্শী। প্রায় ৭০-এর অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। এছাড়াও বিজ্ঞাপন চিত্রেও দেখা যায় তাকে। কানন দেবীর আত্মজীবনী সবারে আমি নমি। শিল্প মাধ্যমে অসাধারণ অবদানের জন্যে ভারত সরকার তাকে ১৯৬৪ সালে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কানন দেবীর জন্য সবচেয়ে বেশি খ্যাতির সময় ছিল। তিনি এ সময় সম্ভ্রান্ত কানন দেবীতে পরিণত হন কানন বালা থেকে। তিনি তখন রোমান্টিক নায়িকার বদলে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকাতেই বেশি অভিনয় করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি শ্রীমতি পিকচার্স গড়ে তোলেন যার বেশির ভাগ ছবিই ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে। এই কোম্পানীর ছবিতে তিনি কেবল অভিনয় ও প্রযোজনাই করেন নি, তিনি পরিচালনাও করেন। তার ছবির পরিচালকের একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট দল ছিল যার নাম সব্যসাচী। তিনি তিন জনের একজন ছিলেন।
কানন দেবী একজন ভাল গায়িকাও ছিলেন। তিনি ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষা নেন। এছাড়াও তিনি ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম, অনাদি দস্তিদার ও পঙ্কজ কুমার মল্লিকদের কাছেও তালিম নেন। তিনি আধুনিক গান ছাড়াও রবীন্দ্র সঙ্গীতও গেয়েছিলেন, যা রবীন্দ্রনাথকেও খুশি করে তুলেছিল। এ গানকে তিনি ভদ্রঘর থেকে বাংলার সাধারণ ঘরেও জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
কানন দেবী ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। চলচ্চিত্রে ইতিহাসবিদ রবি বসু লিখেছেন যে কানন বালাকে দেখে অনেক যুবক ও প্রৌঢ়ের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেত। রূপবাণী সিনেমা হলে এক উদ্ভ্রান্ত যুবক মোহগ্রস্ত হয়ে তার সিনেমার রোমান্টিক দৃশ্যের সময় পর্দার দিকে ছুটে গিয়েছিল তাকে ধরতে। কলকাতার রাস্তায় চট বিছিয়ে তার আলোকচিত্র বিক্রি হত। মহিলারা তার ফ্যাশনে শাড়ি-ব্লাউজ পরা শুরু করেন। কানন দেবী ১৭ জুলাই, ১৯৯২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।