শিরোনাম |
উন্নত কিংবা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বেসরকারি স্কুল শিক্ষকদের বেতন-ভাতা যে খুবই কম, একথা জোর দিয়েই বলা যায়। আর এ কারণে চাকরিপ্রত্যাশীদের শিক্ষকতায় আসার আগ্রহ কম। শিক্ষা সেক্টরে মেধাবীদের উপস্থিতির সংকট চরম হতাশাজনক। নতুন প্রবর্তিত কারিকুলামে শিক্ষকদের কাজের চাপ বেড়েছে, দায়িত্ব বেড়েছে, অথচ বেতন-ভাতার দিক থেকে তারা দিনমজুরের চেয়েও পিছিয়ে।
ফিনল্যান্ডের মতো উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রবর্তন করা হয়েছে। অথচ এ শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনে বাংলাদেশ সবার নিচের সারিতে। একটি সূত্র মতে, আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি। মূলত এগুলো এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে কর্মরত প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। আর মূলত এদের কাঁধেই চাপানো নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের গুরুদায়িত্ব।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই পড়ছে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে। যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গড় হারের তুলনায় দ্বিগুন ও বিশ্বের তুলনায় তিনগুনেরও বেশি। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সহযোগিতায় পরিচালিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব বিষয় জানা যায়।
অথচ দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবচেয়ে কম বেতন প্রাপ্ত হন। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষকরা বেতন পান মাসিক ১১৯ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ১৪ হাজার ১১ টাকা। ২০২৪ সালের ২২ জুন এক ডলার সমান বাংলাদেশের ১১৭ টাকা ৭৪ পয়সা ছিলো। সে হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের শিক্ষকরা পান ১২৫ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ১৪ হাজার ৭১৭ টাকা, শ্রীলংকার শিক্ষকরা পান ১৩৯ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ১৬ হাজার ৩৬৫ টাকা, অর্থসংকটে থাকা পাকিস্তানের শিক্ষকরা পান ১৭৬ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ২০ হাজার ৭২২ টাকা, নেপালের শিক্ষকরা পান ৩৩০ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ৩৮ হাজার ৮৫৪ টাকা, ভূটানের শিক্ষকরা পান ৩৫৮ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ৪২ হাজার ১৫০ টাকা, ভারতের শিক্ষকরা পান ৫১০ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ৬০ হাজার ৪৭ টাকা। আর দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের শিক্ষকরা পান ১২৭৭ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় এক লাখ ৫০ হাজার ৩৫৩ টাকা। অপরদিকে এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে চীনের শিক্ষকরা বেতন পান ১৭৩৬ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ২ লাখ ৪ হাজার ৩৯৬ টাকা, জাপানের শিক্ষকরা পান ২৪৮৫ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ২ লাখ ৯২ হাজার ৫৮৩ টাকা, সৌদি আরবের শিক্ষকরা পান ৪১৬১ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৯১৬ টাকা, সিঙ্গাপুরের শিক্ষকরা বেতন পান এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তাদের বেতন ৫ হাজার ৩০০ ডলার যা বাংলাদেশের টাকায় ৬ লাখ ২৪ হাজার ২২ টাকা।
শিক্ষকদের উচ্চ বেতন দেওয়ার নিরিখে শীর্ষ স্থানে রয়েছে জার্মানি। এই দেশকে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশও বলা হয়। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বছরে ৭০ লক্ষ ৭৩ হাজার ৩৫৬৯ টাকা। রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বার্ষিক বেতন গড়ে ৭ লক্ষ ৩৪ হাজার ১২১ যা প্রতি মাসে ৬১ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
ওয়ার্ল্ড অফ স্ট্যাটিস্টিক্সের রিপোর্ট অনুসারে, নেদারল্যান্ডের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বার্ষিক প্যাকেজ পান ৫৮ লক্ষ ৯৬ হাজার ৫৯৮ টাকা। কানাডায় শিক্ষকরা পান ৫৮ লাখ ৪৯ হাজার ৬৯৩ টাকা৷ অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষকরা পান ৫৭ লক্ষ ৬ হাজার ৯৪০ টাকা। আমেরিকায় শিক্ষকরা বার্ষিক বেতন পান ৬৩ হাজার ৫৩১ ডলার অর্থাৎ ৭৪ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা।
এশিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি বেতন পান দক্ষিণ কোরিয়ায়। এখানে শিক্ষকরা বাৎসরিক প্যাকেজ পান ৬০ হাজার ১৮৫ ডলার অর্থাৎ ৭০ লক্ষ ৮৬ হাজার ১৮১ টাকা। জাপানে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষকরা বেতন পান ৪৯ হাজার ৩৫৫ ডলার অর্থাৎ ৫৮ লক্ষ ১১ হাজার টাকা। ফ্রান্সে প্রাথমিক শিক্ষকদের গড় বেতন ৪০ হাজার ৪২ অর্থাৎ বাংলাদেশি মূদ্রায় প্রায় ৪৭ লক্ষ ১৪ হাজার ৫৪৫ টাকা।
বাংলাদেশের বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন অন্যান্য যেকোন পেশার থেকে সবচেয়ে কম। যেখানে একজন ৮ম শ্রেণি পাস ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ড ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা প্রারম্ভিক বেতন পান। সেখানে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী এমপিও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকার স্কেলে। অবসর ও কল্যাণ সুবিধার শতকরা ১০ টাকা কর্তনের পর বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতাযোগে একজন মাস্টার্স পাস সহকারী শিক্ষক হাতে পান ১৩ হাজার ৩৭৫ টাকা। এই দুর্মূল্যের বাজারে এই স্বল্প পরিমান টাকা দিয়ে ডাল-ভাত খেয়েও যে টিকে থাকা দায়- তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এখন নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় এখন আর শিক্ষকরা বাড়ির পাশের স্কুলেই নিয়োগ প্রাপ্ত হন না। দিনাজপুরের শিক্ষক ফরিদপুর, ফরিদপুরের শিক্ষককে যশোর, আবার খুলনার শিক্ষককে ফরিদপুরের প্রত্যন্ত গ্রামেও চাকরি করতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে নামেমাত্র এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া প্রাপ্ত শিক্ষকদের কপালে কুঁড়েঘরও জোটার কথা না। আর চিকিৎসা ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা। শিক্ষকরা উৎসব ভাতা হিসেবে পান মূল বেতনের শতকরা ২৫ ভাগ। উচ্চতর বেতন স্কেলপ্রাপ্ত ১ম শ্রেণির কর্মকর্তা পদমর্যাদার একজন সিনিয়র শিক্ষক উৎসব ভাতা পান মাত্র সাড়ে ৫ হাজার টাকার মতো। এই টাকা দিয়ে স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা, পরিজন নিয়ে কোন উৎসব পালন করা সম্ভব?
এরূপ বৈষম্যের কারণে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন আর এখন কোন মেধাবী দেখে না বললেই চলে। স্কুল-কলেজের অপেক্ষাকৃত মেধাবীদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে এখন আর কেউ বলে না- বড় হয়ে শিক্ষক হবো। বেতন বৈষম্যই যে এর মূল কারণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি পরিসংখ্যান দেয়া যাক। সারা দেশে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৯৬ হাজার ৭৩৬টি পদ শূন্য। এই শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন জমা পড়েছে ২৪ হাজারেরও কম।
নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন ৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কেই স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারেনি। নৈপুণ্য অ্যাপসে সারা দেশের শতভাগ শিক্ষকরা মূল্যায়ন করার সক্ষমতাও এখন পর্যন্ত অর্জন করেননি। আর যারা সক্ষমতা অর্জন করেছেন তারা সার্ভার জটিলতায় নৈপুণ্য অ্যাপসে মূল্যায়ন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রী শুধু ব্যস্ত শিখন ঘাটতি নিয়ে। ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন কেমন হবে- শিক্ষার্থীদের এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই শিক্ষকদের কাছে। বছরের শুরুতে শিক্ষকদের পাঁচ দিনের এক দায়সারা ট্রেনিং দিয়ে শ্রেণিতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। বিভিন্ন অধ্যায়ের বিভিন্ন বিষয় পাঠদানের উদ্দেশ্য, কৌশল সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণাই পাননি শিক্ষকরা। যেহেতু বর্তমান কারিকুলাম আগের যেকোনো কারিকুলাম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাই শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি।
এদিকে এখনও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ পাননি। এই খাতে বরাদ্দ থাকা দুইশ’ কোটি টাকার বেশি ফেরত যাচ্ছে (সূত্র: দৈনিক সংবাদ, ৯ জুন, ২০২৪)। শিক্ষা নিয়ে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থা কাম্য নয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে এ সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি মেধাবীদের এ পেশায় আনয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনিবার্যতা অনির্বচনীয়।
# লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।