শিরোনাম |
মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, প্রেম-বিরহ সব অনুভূতির গানই এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে পেয়েছে অনন্য মাত্রা। তার শত শত কালজয়ী গান এখনো মানুষের মুখে মুখে। এরমধ্যে আমার সারা দেহ খেও গো মাটি, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস, এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না মনসহ অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান আজও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে তার ভক্তদের হৃদয়ে। আজ এই কণ্ঠশিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকী।
বাংলা সিনেমায় প্লেব্যাক শিল্পী হিসাবে তিনি তিন দশকেরও বেশি সময় একাই রাজত্ব করেছেন।
এন্ড্রু কিশোর ১৯৫৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর রাজশাহী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ এবং মাতা মিনু বাড়ৈ রাজশাহীর একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন । মায়ের কাছে পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয়েছিল। তার শৈশব-কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে রাজশাহী। তার মাতা ছিলেন সংগীত অনুরাগী, তার প্রিয় শিল্পী ছিলেন কিশোর কুমার। প্রিয় শিল্পীর নামানুসারে তার সন্তানের নাম রাখেন ‘কিশোর’। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতেই তিনি সংগীতাঙ্গনেই পা রাখেন।
এন্ড্রু কিশোর লিপিকা অ্যান্ড্রু ইতির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। তাদের কন্যা মিনিম অ্যান্ড্রু সংজ্ঞা এবং পুত্র জয় অ্যান্ড্রু সপ্তক।
এন্ড্রু কিশোর আব্দুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে প্রাথমিকভাবে সঙ্গীত পাঠ গ্রহণ শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কিশোর নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গান শ্রেণিতে রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। কিশোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন।
এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে আলম খান সুরারোপিত মেইল ট্রেন চলচ্চিত্রের "অচিনপুরের রাজকুমারী নেই" গানের মধ্য দিয়ে। তার রেকর্ডকৃত দ্বিতীয় গান বাদল রহমান পরিচালিত এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রের "ধুম ধাড়াক্কা"। তবে এ জে মিন্টু পরিচালিত ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রতীজ্ঞা চলচ্চিত্রের "এক চোর যায় চলে" গানে প্রথম দর্শক তার গান শুনে এবং গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি অন্যান্য প্লেব্যাক গান রেকর্ড করেন যেমন 'ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে', 'ভালবেসে গেলাম শুধু' এর মত জনপ্রিয় সব গান।
কিশোর চলচ্চিত্রের গানে প্রথম সম্মাননা লাভ করেন বড় ভাল লোক ছিল (১৯৮২) চলচ্চিত্রের জন্য। মহিউদ্দিন পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে সৈয়দ শামসুল হকের গীত ও আলম খানের সুরে "হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস" গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এই গানের জন্য তিনি প্রথমবারের মত শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের গীত ও সুরে নয়নের আলো চলচ্চিত্রের তিনটি গানে কণ্ঠ দেন, সেগুলো হল "আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি", "আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন" ও "আমার বুকের মধ্য খানে"। এটি বুলবুলের পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের নির্মাণব্যয় কম থাকার কারণে তিনি সৈয়দ আবদুল হাদী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিনদের মত বড় ও ব্যস্ত শিল্পীদের নিতে পারছিলেন না। ফলে পুরুষ কণ্ঠের জন্য এন্ড্রু কিশোর এবং নারী কণ্ঠের জন্য সামিনা চৌধুরীকে নির্বাচন করেন। তথাপি অভিনেতা জাফর ইকবালের ঠোঁটে তার তিনটি গানই বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯৮৭ সালে তিনি সারেন্ডার চলচ্চিত্রে আলম কানের সুরে তিনটি গানে কণ্ঠ দেন, সেগুলো হল "সবাইতো ভালোবাসা চায়", "গুন ভাগ করে করে", ও "ঘড়ি চলে ঠিক ঠিক"। তন্মধ্যে প্রথমোক্ত গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এই গানের জন্য তিনি তার দ্বিতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ক্ষতিপূরণ (১৯৮৯), পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১), কবুল (১৯৯৬), আজ গায়ে হলুদ (২০০০), সাজঘর (২০০৭) ও কি যাদু করিলা (২০০৮) চলচ্চিত্রের গানের জন্য আরও সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
এন্ড্রু কিশোর এছাড়াও একজন ব্যবসায়ী। ১৯৮৭ সালে তিনি বরাবর আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর, দিদারুল আলম বাদল, শামসুল ইসলাম নান্টু সাথে টিভি নাটক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য প্রযোজনার জন্য একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান 'প্রবাহ' শিরোনামে উদ্বোধন করেন।
২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শারীরিক অসুস্থতার জন্য এন্ড্রু কিশোরকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সেখানে যাওয়ার পর ১৮ সেপ্টেম্বর তার শরীরে ধরা পড়ে ক্যান্সার। সেখানে তিনি কয়েক মাস চিকিৎসা নেন। পরে চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিলে তাকে নিজের ইচ্ছেতেই ২০২০ সালের ২০ জুন রাজশাহীতে আনা হয়।
এরপর তিনি মহানগরীর মহিষবাথানে বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাসায় বসবাস শুরু করেন। ৬ জুলাই সন্ধ্যায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। ১৫ জুলাই রাজশাহী সার্কিট হাউস সংলগ্ন খ্রিস্টান কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।