শিরোনাম |
ইসলাম ধর্মের ইতিহাস অনুযায়ী বিশ্ব নবীগণের জনক হযরত ইবরাহিম (আ.) কে মহান আল্লাহতায়ালা স্বপ্নে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি করার নির্দেশ দেন। হযরত ইব্রাহিম আ. তার সবচেয়ে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করার সিদ্ধান্ত নেন। বরাবরের মতো এবারও তাঁর ঈমানের দৃঢ়তায় আল্লাহতায়ালা খুশি হন এবং ইসমাইলের পরিবর্তে পশু কোরবানি হয়। এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীগণ আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনে হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত পশু কোরবানি করেন।
কোরবানির তাৎপর্য আমাদের ত্যাগ, সমর্পণ ও আত্মশুদ্ধি লাভ করার শিক্ষা দেয়। আত্মশুদ্ধি বলতে 'নিজেকে শুদ্ধিকরণ'। নিজেকে শুদ্ধ করার বা আমাদের ভিতরের কুপ্রবৃত্তিকে ধ্বংস করে মহান আল্লাহর নিকট আনুগত্য ও আত্মসমর্পণই কোরবানি। মানুষ দোষে গুণে চলমান। অনেক সময় লোভ-লালসা, হিংসা- বিদ্বেষ বা অত্যাধিক সম্পদের দাপটে মানুষ যথেচ্ছাচার আচরণ করে। মনের ভিতর তৈরি হয় অহংকার। যাকে আমরা পশুর মতো প্রবৃত্তি বলে থাকি। সেই প্রবৃত্তি থেকে মনকে সংযত করার জন্য বা ধনীর সম্পদেও গরীবের হক প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ইসলাম ধর্মে সামর্থবানদের জন্য কোরবানি ওয়াজিব করা হয়েছে। এইদিন মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ যাদের সম্পদের সামর্থ আছে তারা পবিত্র আল্লাহর নামে এক বা একাধিক পশু কোরবানি করে থাকেন এবং মাংসের নির্দিষ্ট পরিমাণ আত্মীয়- স্বজন, গরীব- দুঃখী সকলের মধ্যে বিতরণ করেন। এভাবেই কোরবানি ঈদ বা ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্তরে আনন্দ বয়ে আনে।
ঈদুল আজহার দিন কোরবানি মূল বিষয় হলেও ঈদের নামাজ পড়া ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় করে থাকে। বাড়িতে বাড়িতে খিচুড়ি, সেমাই, পুডিং, পোলাওসহ বিভিন্ন প্রকার মিষ্টান্ন তৈরি করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী ঈদের নামাজ পড়ে পশু কোরবানির কাজ শুরু হয়। ধর্মীয় বিধি অনুসারে কোরবানির পশুর প্রতি আমাদের যত্নশীল হওয়া কর্তব্য। এই কাজের সাথে জড়িত প্রতিটি জিনিস সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেওয়াও খুব জরুরি। যেমন কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট জায়গা পরিষ্কার রাখা বা আসেপাশে পশুর বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে যেন পরিবেশ নষ্ট না হয় এসব দিকে খেয়াল রাখা।
আর একটা কথা না বললে বিবেকদংশনে ভুগতে হয়। কোরবানির ইতিহাস বা উদ্দেশ্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় পশুগুলিকে কোরবানি করা হয়। সেই পশুদের বাজারে কেনাবেচাসহ পরিবহনে সংশ্লিষ্ট লোকজন মোটেও যত্নবান নয়, এমন তথ্য আমরা প্রায়ই পেয়ে থাকি। এসব ক্ষেত্রে অবলা জীবের প্রতি অত্যাচারের লোমহর্ষক কাহিনি শিউরে ওঠার মতো। পাইপ দিয়ে অতিরিক্ত পানি পেটে ঢোকানো, ঔষধ খাইয়ে মোটাতাজা করা তো আছেই, দূরযাত্রায় পশুগুলিকে এমনভাবে বাঁধা যেন বিশ্রাম নিতে না পারে আবার শোনা যায় চোখে মরিচ ডলে দেয় যেন ঘুমাতে না পারে! এমনকি পিটিয়ে মোটা করার গল্পও শোনা যায়! এসবের একটাও যদি সত্যি হয় তাহলে মানুষ হিসেবে আমরা পশুদেরও অধম এক জাতি। আমরা যারা আরাম আয়েশে থেকে টাকা দিয়ে একটা, দুটো বা অধিক কোরবানি করে সমাজে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করি, সেই পশুদের কোরবানির জন্য তৈরি হওয়ার কষ্টের মাত্রা খেয়ালও করি না। বিষয়টি হয়তো আমাদের সাধ্যের বাইরে, তবু অমানবিক এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করা নিশ্চয় সম্ভব। দায়িত্ব নিয়ে প্রচারণা চালানো যায়, মসজিদে নামাজের সময় এ ব্যাপারে বুঝিয়ে বলা যায়। যে কোনো ভাবে জীবের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। নচেৎ কোরবানির মাহাত্ম্য দুর্বল হয়ে পড়ে। আরও একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায় পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা। এমনিতেই মহল্লার ভিতরের ছোটো ছোটো রাস্তাগুলোতে ময়লার স্তুপ জমা হয়। বড় রাস্তা থেকে ময়লা দ্রুত সরালেও মহল্লার ভিতরের অবস্থা করুণ। এমনিতেই এখন গরমের সময়, বিভিন্ন ফল ফলাদির খোসাসহ নানা প্রকার পচনশীল ময়লায় রাস্তাগুলো সয়লাব। তার উপর কোরবানির বর্জ ভালো করে পরিষ্কার না করলে দুর্গন্ধে মানুষ চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। আর যদি বৃষ্টি পড়ে তাহলে মরার উপর খাঁড়ার ঘা। ঈদ উপলক্ষে জনসমাগম বেশি হয়। রাস্তায় ময়লা আবর্জনা এবং দুর্গন্ধের কারণে চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। তাই পাড়ায়- মহল্লার অলিগলির রাস্তাগুলো পরিচ্ছন্ন রাখা একান্ত আবশ্যক।
ঈদ সকলের জীবনে মঙ্গল বয়ে আনুক। আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় বান্দার কোরবানি কবুল করুন এমনই প্রার্থনা সবার...
# লেখক: নারী নেত্রী ও সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব