শিরোনাম |
❒ সিএজিএম হাইস্কুল : উপেক্ষিত মাউশি ডিজির নির্দেশ
❒ সরকারের গচ্চা গেছে ২১ লাখ টাকা
যশোর সদর উপজেলার সিএজিএম (চান্দুটিয়া আরিজপুর গোবিন্দপুর মটবাড়ি) হাইস্কুল। এই স্কুলে চাকরি করেন লতিকা রানী। দীর্ঘ নয় বছর বিদ্যালয়ে আসেন না তিনি। ফলে, হাজিরা খাতা এবং বেতন বিলে স্বাক্ষর করার প্রশ্নই ওঠে না। স্কুলে না আসলে কী হবে, বেতন তোলার সময় তার স্বামী পঙ্কজ কুমার ঠিকই হাজির হয়ে যান। পেশীশক্তির জোরে স্ত্রীর পরিবর্তে বেতন বিলে স্বাক্ষর করেন তিনি! এরপর ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বছরের পর বছর হজম করছেন লতিকা রানী।
ব্যাপক অনুসন্ধান ও সরকারি দপ্তরের চিঠিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে,শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে লতিকা রানী ২০১৪ সাল থেকে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছিলেন না। তখন মানবিক কারণে তাকে ছাড় দেন স্কুলের শিক্ষকসহ তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটি। সর্বশেষ. ২০১৫ সাল থেকে তিনি একেবারেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন। সেই থেকে এ পর্যন্ত তিনি আর স্কুলে আসেননি। অথচ ১০৫ মাসে বেতন উত্তোলন করেছেন ২১ লাখ ১২ হাজার ১১৯ টাকা। যা সম্পূর্ণ অবৈধ।
এ ধরনের খবর পাওয়ার পর শুরু হয় অনুসন্ধান। অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, লতিকা রানীর পরিবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। দীর্ঘদিন ধরে ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে যারা সভাপতি হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই লতিকা রানীর স্বামী যে রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত সেই দলেরই লোক। এ কারণে তিনি প্রতিটি কমিটির সভাপতিকে বিভিন্নভাবে ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেন। ফলে, বছরের পর বছর বেতন তুলতে অসুবিধা হয়নি পঙ্কজের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ সালে লতিকা রানীর ব্রেনে টিউমার ধরা পড়ে। ২০১৫ সালে তার দু’টি চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান তিনি। সেই থেকে তিনি কোনো ছুটির আবেদন করেননি। জমা দেননি মেডিকেল সার্টিফিকেটও। বছরের পর বছর বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কারণে প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান তাকে একাধিকবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। কিন্তু একবারও জবাব দেননি তিনি। এরপর লতিকা রানীর বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে প্রধান শিক্ষক বিগত জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খানের কাছে আবেদন করেন। আবেদন পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক তৎকালীন জেলা শিক্ষা অফিসার একেএম গোলাম আজমকে সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন। জেলা শিক্ষা অফিসারের নির্দেশে তৎকালীন সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার আশিক আহমেদকে সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার দায়িত্ব দেন। আশিক আহমেদ লতিকা রানীর বাড়িতে গিয়ে তাকে অন্ধ দেখতে পান। এরপর তিনি অন্ধ এবং স্কুলে গিয়ে পাঠদানে অক্ষম বলে প্রতিবেদন জমা দেন। ওই প্রতিবেদনের স্মারক নম্বর ইউএসইও/সদর/যশোর/২০২২/২২, তারিখ-১৩.০১.২০২২। উপজেলা শিক্ষা অফিসের প্রতিবেদন পাওয়ার পর জেলা শিক্ষা অফিস জেলা প্রশাসকের কাছে একই ধরনের তথ্য জানিয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। তার স্মারক নম্বর ৩৭.০১.৪১০০.০০১.১৮.০০৫.১৭.৪৭, তারিখ-২০.০১.২০২২। জেলা প্রশাসক মতামত দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর প্রতিবেদন পাঠান। যার স্মারক নম্বর-০৫.৪৪.৪১০০.০০৮.০১.০০১.২২.৮৩ তারিখ-০৭.০২.২০২২। এরপর মহাপরিচালক নেহাল আহম্মদ জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে শিক্ষিকা লতিকা রানীর শারীরিক অক্ষমতা এবং দৃষ্টিশক্তির বিষয়ে সিভিল সার্জন যশোরের দপ্তর থেকে প্রত্যয়ন ও ফিটনেস সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে মতামত দিয়ে পাঠানোর আদেশ দেন। ওইপত্রের স্মারক নম্বর ৩৭.০২.০০০০.১০৭.৩১.১২৪.২০২২.৫২৩ তারিখ-২০.০৪.২০২২। এরপর জেলা শিক্ষা অফিসার প্রত্যয়ন ও ফিটনেস সার্টিফিকেট চেয়ে সিভিল সার্জন বরাবর পত্র দেন। যার স্মারক নম্বর-৩৭.০২.৪১০০.০০১.৯৯.০১১.১৭.৪২৬, তারিখ-১১.০৫.২০২২। ওই পত্র পাওয়ার পর তৎকালীন সিভিল সার্জন বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করেন। ওই বোর্ডে ছিলেন ডেপুটি সিভিল সার্জন নাজমুস সাদিক, যশোর মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (চক্ষু) নজরুল ইসলাম ও সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার রেহেনেওয়াজ। মেডিকেল বোর্ড লতিকা রানীর দু’টি চোখই অন্ধ বলে জেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রতিবেদন দেয়। যার স্মারক নম্বর সিএসজে/এস-১/২০২২/৪৭০০, তারিখ-২৮.০৬.২০২২। এরপর জেলা শিক্ষা অফিসার মতামত দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর তা প্রেরণ করেন। ওই প্রতিবেদনের স্মারক নম্বর-৩৭.০২.৪১০০.০০১.৯৯.০১১.১৭.৭০০, তারিখ-১৯.০৭.২০২২। সিভিল সার্জনের প্রত্যয়ন ও ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়ার পর এমপিও কমিটির সুপারিশে মহাপরিচালকের পক্ষে মাধ্যমিক-২ শাখার শিক্ষা কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি পত্র বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বরাবর আসে। যার স্মারক নম্বর ৩৭.০২.০০০০.১০৭.৩১.১২৪.২০২২-৭১, তারিখ-১৫.০১২০২২। ওইপত্রে সিএজিএম স্কুলের হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষক লতিকা রানীকে চাকরি থেকে অব্যাহতির নির্দেশ দেয়া হয়।
এরপর মাউশির ওইপত্র নিয়ে বিগত ম্যানেজিং কমিটির ২৯ জানুয়ারির সভায় দীর্ঘ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, সরকারি বিধি অনুযায়ী লতিকা রানীকে অব্যাহতি দেয়ার। একইসাথে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তার বেতন বন্ধ করেন বিগত কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান।
কিন্তু অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস এক তরফাভাবে সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বিগত কমিটির সিদ্ধান্ত বাতিল এবং সরকারি দপ্তরের নির্দেশ উপেক্ষা করে গায়ের জোরে লতিকা রানীকে অব্যাহতি না দিয়ে বেতন চালু করেন। যা বিধি বহির্ভূত। এমনকি বেতন বিলে তার নাম না থাকলে তিনি স্বাক্ষর করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস। এলাকায় প্রচার রয়েছে, লতিকা রানীর চাকরি থাকার শর্তে একতরফাভাবে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসকে সভাপতি করা হয়েছে। সভাপতির এই একগুয়েমির কারণে এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ক্ষুব্ধ হন অভিভাবকরাও। কয়েকজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,‘শিক্ষক না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু ধর্মের ক্লাস হয় না। আগে এক সময় রবিউল ইসলাম নামে একজন মুসলিম শিক্ষক হিন্দু ধর্মের ক্লাস নিতেন। কিন্তু নানা কারণে অনেকদিন ধরে তিনি আর ক্লাস নেন না। এসব কারণে স্কুল থেকে অনেক শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে চলে গেছে। শিক্ষক সংকট দূর না হলে আরও শিক্ষার্থী চলে যাবে। তখন কানা হয়ে যাবে স্কুলটি।’
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান বলেন,‘এলাকার কিছু লোকজন চাপ সৃষ্টি করে বিধি বর্হিভূতভাবে বেতন নিয়ে যাচ্ছে। যার দায়ভাব আমার আর সভাপতির ঘাড়ে পড়ছে। কারণ বেতন বিলে আমার আর সভাপতির স্বাক্ষর থাকে। আমি অনেক চেষ্টা করেও তাকে অব্যাহতি এবং বেতন বন্ধ করতে পারিনি।’
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর অব্যাহতি দিতে পত্র দেয়ায় আগের কমিটি অব্যাহতি দেয়ার পরও লতিকা রানীকে কীভাবে বেতন দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে, সভাপতি অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন,‘দেখি কী করা যায়। প্রয়োজনে আমি পদত্যাগ করবো।’
সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার রবিউল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হয় বিধি বহির্ভূতভাবে সরকারি অর্থ অপচয় হচ্ছে, সেই ব্যাপারে কোনো করণীয় আছে কিনা। উত্তরে তিনি বলেন,‘ওই শিক্ষিকা যে বছরের পর বছর না এসে সরকারি অর্থ উত্তোলন করে নিচ্ছেন সেটি আমার জানা ছিল না। কেউই এভাবে বেতন নিতে পারে না। আর সভাপতিও এভাবে সরকারি অর্থ দিতে পারেন না। আমি খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’