gramerkagoj
শনিবার ● ২৭ জুলাই ২০২৪ ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
gramerkagoj

❒ হায়দার আকবর খান রনো

একজন মার্কসবাদীর বিদায়
প্রকাশ : শনিবার, ১১ মে , ২০২৪, ১১:০৭:০০ পিএম , আপডেট : শুক্রবার, ২৬ জুলাই , ২০২৪, ০৫:০৭:৪৭ পিএম
সরোয়ার হোসেন:
GK_2024-05-11_663fa96491a39.jpg

চলে গেলেন দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও লেখক হায়দার আকবর খান রনো। শনিবার ভোর ২টা ৫ মিনিটে ঢাকার বেসরকারি হাসপাতাল হেলথ অ্যান্ড হোপে জীবনাবসান ঘটে আজন্ম এই বিপ্লবীর। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তীব্র শ^াসকষ্ঠজনিত কারণে মারা যান রনো। মৃতুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং একাধারে শ্রমিক আন্দোলনের নেতা। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবির উপদেষ্টা। এর আগে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যও ছিলেন কমরেড হায়দার আকবর খান রনো। তারও আগে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মতদ্বৈততায় ২০০৯ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি ত্যাগ করেন রনো। কিছুদিন পর যোগ দিয়েছিলেন সিপিবিতে।
দলীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, হায়দার আকবর খান রনোর মরদেহ একটি বেসরকারি হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে আগামী সোমবার সকাল ১০টায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে সিপিবি কার্যালয়ে। সেখানে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর নিয়ে যাওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে দুপুর ১টা পর্যন্ত দেশবাসীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। জোহরের নামাজের পর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে বনানীতে মা ও বাবার কবরের পাশে।
‘আমাদের মাথা কাটা যাবে, কিন্তু হেট হবে না’-যশোর টাউন হল মাঠে শোনা তাঁর প্রথম বক্তৃতার এ লাইনটি আরও বহুবার শুনেছি। কমিউনিস্ট/বামপন্থীদের আদর্শিক দৃঢ়তা বোঝাতে সবসময়ই তিনি এ কথা বলতেন। তাঁর লেখা ‘মার্কসবাদের প্রথম পাঠ’ এর সাবলিল উপস্থাপনায় বিমুগ্ধ হয়েছি। পড়েছি ‘গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাধো’সহ আরও কয়েকটি বই। সবই ছাত্রাবস্থায়। তাঁর লেখা প্রবন্ধ, নিবন্ধে এদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার যে বিশ্লেষণ রয়েছে তার তুলনা তিনি নিজেই। সহজ, সরল আর সাবলীল ভাষায় তাঁর রাজনীতি-অর্থনীতির ক্ষুরধার বিশ্লেষণ যে কোনো পাঠককেই আকৃষ্ট করতে বাধ্য। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকেও তিনি তাঁর লেখার মাধুর্যে পাঠকপ্রিয় করে তুলেছেন। এদেশের কমিউনিস্ট/বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ হায়দার আকবর খান রনোর। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্টদের যে গ্রুপটি বীরচিত ভূমিকা পালন করেছে তিনি তাদের অন্যতম। তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনের অন্যতম রূপকার বলা হয় তাকে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য ছিলেন। কিন্তু, আদর্শিক দ্বন্দ্বের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারেন নি। যোগ দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে। রাজনীতিতে তাঁর নিবেদন, সততা, ত্যাগ তাঁকে যে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তা তিনি কখনো সামান্য ভুলেও বিচ্যুত হতে দেননি। দেশি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির তুখোড় বিশ্লেষক বলা হয় তাকে। মাথা হেট হওয়ার রাজনীতির সময়ে যাঁরা আদর্শিক ঝান্ডাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন হায়দার আকবর খান রনো তাদেরও আদর্শ।
তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত নড়াইলের বরশালা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক পরিবারে সন্তান হায়দার আকবর খান রনো। তিনি ১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। নানা ছিলেন উপ-মহাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিক সৈয়দ নওশের আলী।
পিতা প্রকৌশলী হাতেম আলী খান ১৯৬৮ সালে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। মা কানিজ ফতেমা মোহসিনা ছিলেন বাম রাজনৈতিক কর্মীদের আশ্রয়দাতা। যশোর জিলা স্কুল, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও ঢাকার সেন্টগ্রেগরির ছাত্র রনো স্কুল পরীক্ষায় কখনো দ্বিতীয় হন নি। ১৯৫৮ সালে সেন্টগ্রেগরী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ১২তম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। ১৯৬০ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হন। কিন্তু কারাবাস ও আত্মগোপনে থাকার কারণে কোর্স সম্পন্ন করতে না পেরে জেলে বসে আইনশাস্ত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি হাইকোর্টের সনদও লাভ করেছিলেন। কিন্তু কোনোদিন ওকালতি পেশা গ্রহণ করেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬৩ সাল হতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬১ সালে তিনি মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রাপ্ত ‘সিয়াটো স্কলারশিপ’ এর পুরো অর্থই চাঁদা হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিকে দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানি সামরিক শাসন চলাকালে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট রনো ও কমরেড ফরহাদসহ কয়েকজন ছাত্র গোপনে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিল থেকে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন শুরু করা। কিন্তু, ৩০ জানুয়ারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার হলে তারা ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করেন। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রদের সমাবেশে একমাত্র বক্তা ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো। এটি ছিলো সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য কোনো নেতার প্রথম বক্তৃতা। ৬২ সাল জুড়ে সংগঠিত সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন ও শিক্ষা আন্দোলনের নেতা ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো। ৬২ এর অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়ন পুনর্গঠিত হয়। ওই সম্মেলনে তিনি রাজনৈতিক রিপোর্ট পেশ করেন ও পুনর্গঠিত কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক মনোনীত হন। ৬২ সালে রনো দুইবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মার্চ মাসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ও পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। যেখানে ছাব্বিশ সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তিনি একত্রে ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে ও দক্ষ সাংগঠনিক যোগ্যতার কারণে সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের কারণে ১৯৬৪ সালে তাঁর নামে হুলিয়া বের হয়, যা তখনকার সকল পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। তিনি আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু দুই মাস পর ধরা পড়েন। তাঁকে গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে দুই দিন ও দুই রাত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাখা হয়েছিল। ঘুমাতে দেয়া হয়নি তাঁকে। মাথার উপর রাখা হয়েছিল অনেক পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতি। ১৯৬৫ সালের জেলে থাকাকালেই ছাত্র ইউনিয়নের একাংশকে (মেনন গ্রুপ) সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ইতিমধ্যে ১৯৬৫ সালে তিনি রেল ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আবার কারারুদ্ধ হন। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, মুক্তির পর তিনি আর ছাত্র সংগঠন করবেন না এবং সরাসরি শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হবেন। ১৯৬৬ সালে কাজী জাফর আহমদের সাথে টঙ্গীতে শ্রমিক আন্দেলনে সঙ্গে যুক্ত হন রনো। এই দুইজন একত্রে টঙ্গী অঞ্চলে যে শ্রমিক আন্দেলন গড়ে তুলেছিলেন তা বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। আন্দোলনের স্বার্থে রনো ঢাকার বাসা ছেড়ে টঙ্গীর শ্রমিক বস্তিতে থাকতে শুরু করেন।
টঙ্গীতে যে ধরণের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল এবং শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর যে জনপ্রিয়তা ছিল তাতে টঙ্গী অঞ্চল থেকে পুলিশের পক্ষে খুব বড় রকমের প্রস্তুতি ও ঝুঁকি নেয়া ছাড়া তাঁকে গ্রেপ্তার করা সহজ ছিল না। এরপর তিনি আর কখনো গ্রেপ্তার হননি। তবে আত্মগোপনে গেছেন অনেকবার।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও তাঁর ভূমিকা ছিল। একদিকে টঙ্গীতে শ্রমিক আন্দোলন, পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা দুটোই চালিয়ে গেছেন রনো। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর নেতৃত্বে টঙ্গী থেকেই শুরু হয় ঐতিহাসিক ঘেরাও আন্দোলন। তিনি তখন টঙ্গীর বাইরে অন্যান্য শ্রমিক অঞ্চলেও যেতেন সংগঠন গড়ে তুলতে।
১৯৬৯-৭০ সালে দ্বিতীয় সামরিক শাসনামলে টেক্সটাইল শ্রমিকদের দুইমাসব্যাপী ঐতিহাসিক ধর্মঘট হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে। টঙ্গী অঞ্চলে অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছিলেন এই সাহসী নেতা। ১৯৭০ সালে তিনি তদানীন্তন সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালে মতাদর্শগত কারণে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে পড়লে হায়দার আকবর খান রনো চিনপন্থী অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তী দুই বছরে ওই অংশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে একত্রে গঠন করেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি সশস্ত্র ঘাঁটি তৈরি করা হয়। এদের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। ২৭ মার্চ অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি শিবপুর যান এবং এখান থেকে সমন্বয়কমিটির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র ঘাঁটিগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ৩ এপ্রিল তিনি এবং রাশেদ খান মেনন টাঙ্গাইলে মাওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করেন মুক্তিযুদ্ধের করণীয় নিয়ে আলোচনার জন্য। কিন্তু, পরের দিন পাক বাহিনী মাওলানার বাড়িতে হানা দিলে মাওলানা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ’৭১-এর ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পর্টির সহায়তায় বামপন্থীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। হায়দার আকবর খান রনো এই কমিটির ঘোষাণাপত্র রচনা ও পেশ করেছিলেন।
১৯৭১ সালেই তাঁর পরিচয় হয় ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোজাফফর আহমদসহ ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন নেতার সাথে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাথেও রয়েছে তাঁর ঘনিষ্ট যোগাযোগ। এসব কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের অনেক সম্মেলনেও তিনি যোগাদান করেছেন। ১৯৭৩ সালে তাঁরা গঠন করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)। ১৯৭৯ সালে পার্টির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টি। ১৯৭৯ থেকে ৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে পলিটব্যুরোর সদস্য।
ছাত্রাবস্থায় মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী হলেও এবং বিভিন্ন সময় ন্যাপের কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখলেও তিনি কখনো ন্যাপের সভ্য হননি। ১৯৭৪ সালে ইউপিপি গঠিত হলে তিনি তাঁর সহ-সভাপতি হন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জাতীয় পর্যায়ের সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে তিনি যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় তিনি বুর্জোয়া সুবিধাবাদ ও কমিউনিস্টদের নানা বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং প্রতিটি রাজনৈতিক প্রশ্নে শ্রমিক শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তব সাংগঠনিক আন্দোলনগত কাজের মধ্য দিয়ে। কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর মধ্যে বাস্তব সংগ্রাম ও তত্ত্বের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। তিনি অত্যন্ত সাহসী এবং নীতি-আদর্শের প্রতি অবিচল একজন পরিশীলিত কমিউনিস্ট রাজনীতিক। এরশাদ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রথম থেকেই নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। এসময় সাতবার তাঁর নামে হুলিয়া জারি এবং বাড়িতে পঞ্চাশ বারের বেশি মিলিটারি পুলিশের অভিযান হয়েছে। প্রতিবারই তিনি আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের তিনি ছিলেন অন্যতম রূপকার।
তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২৪ বছর বয়সে ‘সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা’। তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য বইগুলো হলো শতাব্দী পেরিয়ে, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ফরাসী বিপ্লব থেকে আক্টোবর বিপ্লব, পুঁজিবাদের মৃত্যু ঘণ্টা, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর, রবীন্দ্রনাথ-শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে, মানিক বন্দোপাধ্যায় ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, রাজনীতির কথা প্রসঙ্গে, বিবিধ প্রসঙ্গ, গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাধো, মার্কসবাদের প্রথম পাঠ, মার্কসীয় অর্থনীতি, মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম, কমিউনিস্ট আন্দোলনের তিনধারা, সিপিবির বন্ধুদের প্রতি, চীনপন্থী বন্ধুদের প্রতি, কোয়ান্টাম জগৎ-কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা, জাপান যাত্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শহীদ আসাদ, উত্তাল ষাটের দশক, এশীয় অর্থনীতিতে পুঁজির সঞ্চয় ও নারীশ্রম, আজকের সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট, স্ট্যালিন প্রসঙ্গে, মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ।
২০০৫ সালে তাঁর ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ প্রথম আলোর দৃষ্টিতে বছরের সেরা বই হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। তাঁর কিছু লেখা বিদেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
হায়দার আকবর খান রনো খুব সরল জীবনযাপন করতেন এবং সকলেই তাঁর আন্তরিকতার স্পর্শে মুগ্ধ হতেন। একমাত্র রাজনীতি ছাড়া অন্য কোনো পেশা তিনি গ্রহণ করেন নি। বই পড়া, আবৃত্তি করা, সময় পেলে ক্রিকেট খেলা আর সিনেমা দেখা তাঁর শখ ছিলো। বাংলা ও ইংরেজি বহু কবিতা তিনি মুখস্ত বলতে পারতেন। অনর্বশী বক্তা হায়দার আকবর খান রনোর বক্তৃতাও কাব্যময় হয়ে ওঠতো সাবলীল উপস্থাপনায়।

আরও খবর

🔝