শিরোনাম |
বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান। গ্রামীণ সংস্কৃতি শহরের সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। গ্রামের খেলাধুলা, হাডুডু, গোল্লাছুট প্রভৃতি। জারিগান, সারিগান, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, কীর্তন, হাতে খড়ি, গ্রামের হাট বাজার, মেলা, ঘোড়দৌড়, ঘুড়ি উড়ান, ফসল উৎপাদন ও কাটার সমবেত সংগীত, বেশভূষাসহ উৎসবগুলো শহরের আধুনিক সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গ্রামে প্রচলিত সংস্কৃতির মধ্যে শীতকালীন পিঠা, পায়েস ও নবান্ন উৎসব অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রানবন্ত সংস্কৃতি। শীতকাল এলে এই পিঠা উৎসব ঘরে ঘরে পালিত হয়। গ্রামের মা বোনেরা নানা প্রকার পিঠা তৈরি করে পরিবারসহ প্রতিবেশীদেরও সরবরাহ করে। এভাবে পিঠা উৎসব সৃষ্টি হয় এবং সকলে মহানন্দে বিভিন্ন পিঠা ভক্ষণ করে। পিঠাগুলোর মধ্যে পাটিসাপটা, পুলি, চিতই, মুগ সামালি, চুষি, কাঁচি পোড়া, ভাপা পুলি, চন্দ্রপুলি প্রভৃতি এইসঙ্গে পায়েসও (পরমান্ন) ঘরে ঘরে তৈরি হয়।
এই সমস্ত পিঠা পায়েস তৈরি করার উপাদান গ্রামে বিদ্যমান। পিঠার উপকরণগুলো হচ্ছে নারিকেল, গুড়, খেজুরের রস, চালের গুড়া ক্ষেতের ধান থেকে চাউল। সেই চাউল থেকে গুড়া আর গোয়ালের গাভীর দুধ। এসব উপাদান সংগ্রহ হয় নারিকেল গাছ, খেজুর গাছ ক্ষেতে উৎপাদিত ধান এবং গোয়াল ভরা গাভী থেকে। গ্রামের বাড়িতে থাকা ঢেকির চালের গুড়া তৈরি, নারিকেল ভেঙে কুরিয়ে নেয়া মূল অংশ গ্রহণ, খেজুরের রস এবং রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি-এভাবে উপাদান গুলো সংগ্রহ করে পিঠা পায়েস তৈরি হয়। এরপর প্রতিবেশীদের সঙ্গে পিঠা বিনিময় এবং পরিবারের সদস্যগণ সবাই মিলে ভক্ষণ- সে কি আনন্দ।
ক্রমে গ্রামের সেই সংস্কৃতি লুপ্ত হয়ে যাবার পথে। গ্রাম থেকে অনেকেই শহরে চলে এসেছে। শহরের নাগরিক সভ্যতায় তাদের পুত্র কন্যাগণ নাগরিক সংস্কৃতি গ্রামের উপর প্রভাব ফেলেছে। তাই নারিকেল গাছ, খেজুর গাছের চাষ কম হচ্ছে। বাড়িতে ঢেকির প্রচলন বিলুপ্ত, চালের গুড়া তৈরি করতে চাষিরা শহরের মিলে আসছে। গোয়ালের গাভীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটায় গ্রামের যুবকেরা আর নারকেল গাছে ওঠে না, খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছে ওঠে না। শহরের সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রভাবে যুবক যুবতীরা প্রাচীন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শহরের নিষ্প্রাণ সভ্যতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে তাই লিখেছিলেন:
"দাও ফিরিয়ে সে অরন্য-লও হে নগর, দাও যত লৌহ, কাষ্ঠ ও প্রস্তর। হে নবী সভ্যতা।"
গ্রামীণ সেই সংস্কৃতি অধুনা শহরে আগত বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা যুবক-যুবতীদের উৎসাহিত করে নানা প্রকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উৎসব করছেন। যুবক-যুবতীবৃন্দ অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতি শহরে বিকাশ ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই হারানো সংস্কৃতি উদযাপন করছে। গ্রামীণ সেই সংস্কৃতিক উৎসবের মধ্যে পিঠা উৎসব অন্যতম। শীতকালে এই অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন করা হয়। ছেলেরা রস, গুড়, নারকেল জোগাড় করে দেয় আর মেয়েরা এই সমস্ত দিয়ে নানাপ্রকারের পিঠা তৈরি করে।
সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পিঠা উৎসবের আয়োজন করে। আমন্ত্রিত হয়ে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পেশার মানুষের সমাবেশ ঘটে।গ্রামীণ সংগীতানুষ্ঠানের শেষে উপস্থিত ব্যক্তিগণ পিঠা খেয়ে পরম তৃপ্তি লাভ করেন। শহরের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের মধ্যে সৃষ্ট ব্যবধান দূরীভূত হয়।উভয় স্থানের (গ্রাম ও শহর) মানুষের মধ্যে প্রীতির মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়।
শিল্পকলা একাডেমির এই পিঠা উৎসব সেই দৃষ্টান্ত বহন করে।