gramerkagoj
শুক্রবার ● ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
gramerkagoj
এক গ্রামেই মারা গেছে ২৮ জন !

❒ যশোরে আর্সেনিক বিষক্রিয়া-১

প্রকাশ : শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারি , ২০২২, ১১:৫৭:৩০ পিএম
শাহানুর আলম উজ্জ্বল, চৌগাছা (যশোর) :
1642183081.jpg
যশোরের চৌগাছার মাড়ুয়া গ্রামের মানুষের কাছে পানির অপর নাম মরণ! চৌগাছা পৌর সদর থেকে উত্তর-পূর্ব কোণে দশ কিলোমিটার দূরে এই এক গ্রামেই গত ৩০ বছরে ক্ষতিকর মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে ২৮ জন মারা গেছেন। মৃত্যু পথযাত্রী আরও অনেকে। খালি চোখে পানিতে আর্সেনিক যেমন দেখা যায় না, তেমনি এর কোনো গন্ধও নেই। আর্সেনিকের উপস্থিতি প্রথম টের পাওয়া যায় যখন সংক্রমণে চামড়ায় ক্ষত দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ০.০১ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার পানিতে। বাংলাদেশে ০.৫ মিলিগ্রামে সহনীয় মাত্রা ধরা হয়। এর বেশি হলেই মানুষের শরীরের জন্য তা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের গবেষণায় জানা যায়, উপজেলার মাড়ুয়া গ্রামে গড়ে প্রতিলিটারে ৮৫ ও গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় ১০০ মিলিগ্রাম আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সেই গবেষণায় আরও জানা যায়, মাড়য়া গ্রামের পাঁচ হাজার মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী ও পুরুষ বিভিন্ন মাত্রায় আর্সেনিকে আক্রান্ত।সরেজমিন মাড়ুয়া গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় গেলে সড়কের ডান পাশে একটি বাড়ি লক্ষ্য করা যায়। চারপাশের ইটের প্রাচীর, লোহার গেট। বাড়ি দেখলেই বোঝা যায় পরিবারটি সচ্ছল। কিন্তু গেটে তালা। এই বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। বাড়ির তিনজন ভয়াবহ আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বেঁচে আছেন আর্সেনিকে মৃত আয়ুবের স্ত্রী জাহানারা বেগম (৩৮)। ভয়ে তিনি মহেশপুরের ভালাইপুর গ্রামের বাবার বাড়িতে বসবাস করছেন। আর্সেনিকে আক্রান্ত লুৎফর রহমান জানান, এই পরিবারে ২০০৭ সালে কাশেম আলী (৬৫), ২০১৩ সালে তার স্ত্রী পদ্মা খাতুন (৫১) এবং ২০১৬ সালে ছেলে আয়ুব হোসেন (৪৫) মারা যান। গ্রামের বাসিন্দা রোকেয়া বেগম (৫৬) বলেন,‘আমার পুরি (বংশ) সব শেষ হয়ে গেছে বাবা। আমার ডান হাতের দু’টি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়েছে। ২০০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় আমার অপারেশন হয়। আমি এখনো সুস্থ না। আমার সারা শরীরে দাগ। আর্সেনিকের কারণে আমাদের পরিবারে সাতজন মারা গেছে।’ বর্তমানে তিনি যশোরে ছেলের বাসায় থাকেন।তিনি জানান, ১৯৯০ সালে প্রথম মারা যান তার দেবর আনিছুর রহমান (২০)। ১৯৯১ সালে তার শ্বশুর গ্রাম ডাক্তার ইয়াকুব আলী (৭০), ২০০৪ সালের স্বামী মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন (৫৫), ২০০৬ সালে শাশুড়ি নূরজাহান (৬৫), ২০০৮ সালে দেবর সাবেক কৃষি অফিসার আব্দুল আজিজ (৫২), ২০০৯ সালে ইউছুফ আলী (৩৫), আর ২০১৩ সালে ইউছুফের স্ত্রী সালমা খাতুন (৩০) মারা যান। জাপানি সংস্থা জাইকা তাদের নিশ্চিত করে, তারা সকলেই আর্সেনিকের কারণে মারা গেছেন। মাড়ুয়া ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আর্সেনিকে আক্রান্ত ইমতিয়াজ আলী জানান, এ গ্রামের অল্পসংখ্যক লোক বাদে সকলে আর্সেনিকের রোগী। তিনি বলেন, আর্সেনিকে ২০১৭ সালে মারা যান আকরাম হোসেন (৪০)। আর্সেনিকে আক্রান্ত হওয়ার পর তার বাম হাতের দু’টি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়। তারপরও দরিদ্রতা ও অভাবের কারণে চিকিৎসা নিতে না পারায় ভুগে ভুগে অবশেষে মারা যান তিনি। এছাড়া আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে ২০১৫ সালে নূর ইসলাম (৫৫), ২০০৬ সালে হোসেন আলী (৫০), ২০০৫ সালে তার স্ত্রী ময়না বিবি (৪০), ২০০২ সালে মুক্তার আলী (৪৫), ২০১২ সালে আতিয়ার রহমান (৪৮), ২০০৩ সালে আক্কাচ আলী (৪৪), ২০০২ সালে মনসের আলী (৪২), ১৯৯৮ সালে ইলাহুড়ি (৬৭), ২০১৩ সালে ইউনুছ আলী (৫৫), ২০১৮ সালে গোবিন্দ কর্মকার (৬০) ও দীনবন্ধু কর্মকার (৪৩), মমতাজ বেগম (৪৪) ও মাজেদা বেগম (৩২), ২০১৯ সালে সামছুদ্দিন (৭০), জবেদা বেগম (৬৫) ও হাকিম দর্জি (৪৫), ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহাতাব মিস্ত্রি (৭০) ও জুন মাসে আবদার রহমান (৬৮) মারা যান। আর্সেনিকে আক্রান্ত মাড়ুয়া বাজার মসজিদের মুয়াজ্জিন আনছার আলী (৭০) জানান, তিনি ২৪ বছর ধরে এ রোগে ভুগছেন। এখন তার শ্বাসকষ্ট আর হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। মাঠের ১০ কাঠা জমি বিক্রি করে চিকিৎসা নিয়েছেন। তারপরও সুস্থ হননি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক ডক্টর শফিকুল ইসলাম গ্রামের কাগজকে বলেন,‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ডক্টর খালেদ হোসেনের সাথে তারা আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যু ঠেকানোর বিষয়ে কাজ করছেন। আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্তদের সরাসরি কোনো চিকিৎসা নেই। পানি ফুটালেও আর্সেনিক যায় না বরং পানি শুকিয়ে গেলে আর্সেনিকের ঘনত্ব আরও বাড়ে।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমাদের আর্সেনিকযুক্ত পানির উৎস বন্ধ করে স্থায়ীভাবে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে হবে। ১৯৯০ সালের পর থেকে যারা আক্রান্ত তাদের মধ্যে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়ে গেছে। আর্সেনিকে আক্রান্ত হলে শরীরের উপসর্গ ও জীবনের ঝুঁকি কমাতে খাদ্য পুষ্টির সাথে সম্পর্ক আছে। যে সকল পরিবার পুষ্টির ব্যাপারে সচেতন তাদের মৃত্যু অনেকটাই দেরিতে হয়েছে।’ মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় দু’ কোটি মানুষ কমবেশি আর্সেনিক বিষক্রিয়ার ঝুকিঁতে রয়েছে।

আরও খবর

🔝