gramerkagoj
শনিবার ● ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
gramerkagoj

❒ সপ্তাহজুড়ে দেখা যাবে

উজ্জ্বলতা ছড়াতে বিস্ফোরণ ঘটবে বিরল নক্ষত্রের
প্রকাশ : শনিবার, ২৩ মার্চ , ২০২৪, ০২:১৬:০০ পিএম
কাগজ ডেস্ক:
GK_2024-03-23_65fe8c5d5dd4f.jpg

একটি ‘নতুন তারার’ আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে এ বছর। এই নতুন তারা আকাশকে করবে আরো আলোকিত। তারাটিতে বিশাল পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা প্রায় এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে উজ্জ্বলতা ছড়াবে। এটি খালি চোখে দেখা যাবে মাত্র কয়েকদিন। এর পর দেখতে হবে বাইনোকুলার দিয়ে।
এমন মহাজাগতিক ঘটনা এক জীবনে একবারের বেশি খুব কমই দেখা সম্ভব। এই ধরনের ঘটনাকে বলা হয় নোভা। এটি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির করোনা বোরিয়ালিস বা নর্দার্ন ক্রাউন নক্ষত্রমণ্ডলে ঘটবে। করোনা বোরিয়ালিস বুয়েটস ও হারকিউলিস নক্ষত্রমণ্ডলের মাঝামাঝি অবস্থিত।
এই বিস্ফোরণ যে নক্ষত্রে ঘটবে সেটি ‘টি করোনা বোরিয়ালিস’ বা টি সিআরবি (T CrB) নামে পরিচিত। নক্ষত্রটি অবস্থিত পৃথিবী থেকে ৩ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের আকাশে অবস্থান এর।
কোনও বিশাল নক্ষত্রের বিস্ফোরক মৃত্যুকে বলা হয় সুপারনোভা। আর নোভা বলতে বোঝায় সাদা বামুন নামে পরিচিত কোনও মৃত নক্ষত্রে আকস্মিক ও সংক্ষিপ্ত বিস্ফোরণ।
টি করোনা বোরিয়ালিস ‘ব্লেজ স্টার’ নামেও পরিচিত। এটি করোনা বোরিয়ালিসের একটি প্রায় গোলাকার বাইনারি স্টার সিস্টেম, যাতে একটি মৃত সাদা বামন তারকা ও বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়া একটি রেড জায়ান্ট বা লাল দানবীয় তারকা রয়েছে। পারমাণবিক ফিউশনের মাধ্যমে যখন কোনও নক্ষত্রের সব হাইড্রোজেন উবে যায় তখন সেটি রেড জায়ান্টে পরিণত হয়। নক্ষত্রটি তখন মারা যেতে থাকে।
আজ থেকে ৫০০ বা ৬০০ কোটি বছর পরে আমাদের সূর্যও একটি লাল দৈত্যে পরিণত হবে, ফুলে উঠবে এবং চারদিকে প্রসারিত হবে। এর বস্তুগত উপাদানের স্তরগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে। এর ফলে সম্ভবত সৌরজগতের অভ্যন্তরীণ গ্রহগুলোও বাষ্পীভূত হয়ে উবে যাবে। আমাদের পৃথিবীটাও হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে। পুরো সৌরজগতে নেমে আসবে কেয়ামত।
টি সিআরবির বিস্ফোরণ পুরো করোনা বোরিয়ালিস নক্ষত্রমণ্ডলকে আলোকিত করবে। তারাটিকে প্রায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আমাদের উত্তর আকাশের বিখ্যাত নর্থ স্টার বা ধ্রুব তারা নামে খ্যাত পোলারিসের মতো উজ্জ্বল দেখাবে।
তবে ঠিক কবে থেকে এটি দেখা যাবে তা অনিশ্চিত। নাসা বলছে, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটবে। টি সিআরবিতে প্রতি ৭৯ বছরে অথবা তার কিছু আগে বা পরে এমন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
ঘটনাটি ঘটে যখন সাদা বামন নক্ষত্র ও লাল দৈত্য নক্ষত্রটি একে অপরের খুব কাছাকাছি চলে আসে। সাদা বামন নক্ষত্রটি আকারে প্রায় সূর্যের সমান কিন্তু মৃত এবং লাল নক্ষত্রটিকে ঘিরে ঘুরছে। আর লাল দৈত্য নক্ষত্রটি তার আয়ুর শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে এবং সূর্যের আকারের প্রায় ৭৪ গুণ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। এটি এখন শরীর ক্ষয়ে ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে।
প্রতি ৮০ বছরে নক্ষত্র দুটি যখন পরস্পরের খুব কাছাকাছি চলে আসে তখন লাল দৈত্যাকার নক্ষত্রের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪ হাজার বা ৫ হাজার ৮০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে হঠাৎ করেই ৩ লাখ ৬০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইটে উঠে যায়। এতে লাল নক্ষত্রের বাইরের স্তর খসে খসে সাদা বামুন নক্ষত্রের ওপর গিয়ে পড়ে।
এর ফলে সাদা বামুন নক্ষত্রের বায়ুমণ্ডলও অনেক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণে আমাদের সূর্যের বার্ষিক শক্তি উৎপাদনের চেয়ে এক লাখগুণ বেশি শক্তি নির্গত হয়। পৃথিবীর সময়ের হিসাবে প্রায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই পারমাণবিক বিস্ফোরণ ও শক্তি বিকিরণ চলতে থাকে এবং অন্ধকার মহাকাশ আলোকিত হয়ে উঠে। এই ঘটনাকেই বলে নোভা।
নোভার ঘটনায় লাল দৈত্যাকার নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটে না। বরং ৮০ বছর পরপর একের পর এক নোভার ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। এরপর একসময় নক্ষত্রটি পুরোপুরি বিস্ফোরিত হয়ে সেটির মৃত্যু ঘটে। আর সেই ঘটনাকেই বলা হয় সুপারনোভা। মৃত্যুর পর লাল নক্ষত্রটিও সাদা বামুন নক্ষত্রে পরিণত হয়, এরপর তা ধীরে ধীরে কালো বা অন্ধকার বামুন নক্ষত্রে রূপ নেয়। আর তাকে ঘিরে থাকা সাদা বামুন নক্ষত্রটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যায়। অনেক সময় বিশাল কোনও নক্ষত্র মৃত্যুর পর নিউট্রন তারা বা ব্ল্যাকহোলেও পরিণত হতে পারে।
সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় পুরো গ্যালাক্সি আলোকিত হয়ে ওঠে এবং অনেক বেশি শক্তি নির্গত হয়। সুপারনোভা তুলনামূলকভাবে বিরল ঘটনা, যা আমাদের ছায়াপথে প্রতি ৫০ বছরে একবার ঘটে। অন্যদিকে, নোভা প্রতিবছরই ঘটে। আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রতি বছরই বেশ কয়েকটি নোভা বিস্ফোরণ ঘটে। তবে আমরা সব দেখতে পাই না।
দুটো ঘটনাই মহাজাগতিক জীবনচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুপারনোভা সমগ্র মহাবিশ্ব জুড়ে প্রাণের প্রয়োজনীয় উপাদান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর নোভা নাক্ষত্রিক প্রক্রিয়া ও বাইনারি স্টার সিস্টেম বা দ্বৈত নক্ষত্রের গতিবিদ্যা বোঝার ক্ষেত্রে অবদান রাখে।
টি সিআরবিতে সর্বশেষ বিস্ফোরণ ঘটেছিল ১৯৪৬ সালে। তার আগে ১৮৬৬ সালেও টি সিআরবির উজ্জ্বল হয়ে ওঠার লিখিত রেকর্ড পাওয়া যায়। তার আগে ১৭৮৭ সালে রেভারেন্ড ফ্রান্সিস উল্যাস্টন ও ১২১৭ সালে অ্যাবট বারচার্ড নামে দুজন মহাকাশ পর্যবেক্ষকের লেখায়ও করোনা বোরিয়ালিস নক্ষত্রমণ্ডলে উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখা যাওয়ার সাক্ষ্য মেলে।
নাসা মেটেরয়েড এনভায়রনমেন্টস অফিসের প্রধান উইলিয়াম জে কুক বলেন, “অধিকাংশ নোভা অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে, কোনও পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই। টি সিআরবি আমাদের গ্যালাক্সির ১০টি পুনরাবৃত্ত নোভার একটি। ১৯৪৬ সালের শেষ বিস্ফোরণ থেকে আমরা জানি, তারাটি উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির আগে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ম্লান হবে। টি সিআরবি গত বছরের মার্চে ম্লান হতে শুরু করেছে। এ থেকে গবেষকদের ধারণা, এখন থেকে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে এতে নোভা বিস্ফোরণ ঘটবে।”
এটি যখন উজ্জ্বল হবে তখন মনে হবে যেন আকাশে কোনও নতুন তারার আবির্ভাব ঘটেছে। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ থেকে তারাটি স্পষ্টভাবে দেখা যাবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে নাসার অ্যাকাউন্ট নাসাইউনিভার্স থেকে টি সিআরবির বিস্ফোরণ ও আবির্ভাবের তথ্য জানানো হবে।
উইলিয়াম জে কুক ১৯৭৫ সালে নোভা সিগনির বিস্ফোরণও দেখছিলেন। সে ঘটনার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “আমি তখন এক জ্যোতির্বিজ্ঞান-পাগল কিশোর। সবেমাত্র কলেজে পড়া শুরু করতে যাচ্ছিলাম। সে বছরের ২৯ আগস্ট রাতে আমি বাইরে ছিলাম। তখনই আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই যে, সিগনাসের নক্ষত্রমণ্ডলটি এলোমেলো হয়ে গেছে; সেখানে একটি নতুন তারা দেখা যাচ্ছে, যেটি আগে ছিল না।”
তিনি বলেন, “বিষয়টি বন্ধুদের কাছে বলার পর তারা প্রথমে ভেবেছিল আমি পাগল। পরে আমি তাদের দেখাতে পেরেছিলাম এবং আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আমরা একটি নোভা দেখছি!
“এটি খুবই স্মরণীয় একটি অভিজ্ঞতা ছিল এবং জ্যোতির্বিদ্যাকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে আমাকে আরও বেশি উৎসাহিত করেছিল। আমি প্রায়ই রসিকতা করে বলতাম, পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক করার সময় আমাকে ভোগাতে কোনও একটি নক্ষত্রকে বিস্ফোরিত হতে হবে।”
তথ্যসূত্র: সিএনএন, আর্থ ডটকম, স্পেস ডটকম, লাইভ সায়েন্স

আরও খবর

🔝