gramerkagoj
শুক্রবার ● ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
gramerkagoj
অপেক্ষায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ
প্রকাশ : শনিবার, ২১ মে , ২০২২, ০২:২৮:০২ পিএম
কাগজ ডেস্ক:
1653121713.jpg
স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জন্য মুখিয়ে আছে পুরো দেশ। উচ্ছ্বসিত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার মানুষ। সেতুর কাজ ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। গতকাল শুক্রবার পদ্মা সেতু এলাকায় গিয়ে এবং আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন প্রায় প্রতিদিনই শত শত মানুষ কেউ পরিবার নিয়ে, কেউ দলবল নিয়ে গাড়ি ভাড়া করে পদ্মা সেতু দেখতে আসছে। এ নিয়ে আলোচনায় মুখর পদ্মা সেতুর দুই পাড়। সেতুর আশপাশের বাসিন্দাদের মনেও আনন্দ। খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মা পারাপারে কত যে মানুষের প্রাণ গেছে। এখন সেতু মিলিয়েছে পাড়।কথা হয় মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের বাসিন্দা ৫০ বছর বয়সী নার্গিস বেগমের সঙ্গে। ছোট থেকে নদীর পাড়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। পারিবারিকভাবে বিয়েও হয়েছে একই এলাকায়। তিনি বলেন, ‘এ পদ্মার পাড় একসময় অবহেলিত জনপদ ছিল। মানুষ এখানে তেমনটা আসত না। এখন আপার (প্রধানমন্ত্রী) জন্য এই এলাকা খুব দামি হয়ে গেছে। এই এলাকার আশপাশে যাদের জমি ছিল তারা আজ কোটিপতি। আমার পরিবারও অল্প জায়গার বিনিমিয়ে সরকার থেকে ৯০ হাজার টাকা পেয়েছে। এলাকার উন্নয়নের জন্য আপাকে ধন্যবাদ জানাই।’ শুধু নার্গিস বেগম নন, তার মতো অন্য সবারও একই কথা।প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৩ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে যেকোনো দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হবে। বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা ও প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানাসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যরাও এ সময় উপস্থিত থাকতে পারেন। এ সেতুর কাজ দেখতে গিয়ে এর আগে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, দুই বোন প্রায় দুই কিলোমিটার সেতুর ওপর হেঁটেছেন। সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই বোন দীর্ঘক্ষণ গল্প করেছেন। এরও আগে প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করতে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে আসা-যাওয়ার পথে নিজে মোবাইল ফোনে সেতুর ছবি তুলেছেন দু-তিনবার।সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত বৃহস্পতিবার একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যেদিন তারিখ নির্ধারণ করবেন সেদিনই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। জুনের শেষ সপ্তাহেই সেতুর উদ্বোধন হতে পারে বলেও জানান তিনি।আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে শেখ হাসিনা ও দেশের ১৬ কোটি মানুষের আবেগ জড়িত। এ সেতুর উদ্বোধন নিয়ে অনেক বেশি আবেগাপ্লুত সরকারপ্রধান। কারণ এ সেতুর পরিকল্পনার পর থেকেই দেশ-বিদেশি ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। ষড়যন্ত্রের একপর্যায়ে সেতুর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সেতু নির্মাণে অর্থায়ন না করার ঘোষণা দেয়।আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক গতকাল বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অভিযোগ এনে টাকা দেওয়ার পথ রোধ করে, তখন সবাই ভেবেছিল পদ্মা সেতু আর হবে না। এটা স্বপ্নই থেকে যাবে। বিএনপি নেতিবাচক প্রচার চালাতে থাকে। সেই পরিস্থিতিতে নেত্রী (শেখ হাসিনা) ঘোষণা দেন, প্রয়োজন হলে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু হবে। সত্যিই তাই হলো। আজ নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আবেগ তো আছেই, সবারই একটা আবেগ কাজ করে।’সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত সহজ হবে, সময়ও কমবে। চলাচল সহজ করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এ সেতু। সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।আসছে জুন মাসের শেষদিকে পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। গতকাল সেতু প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জুনের ২৫ না হয় ২৭ তারিখ উদ্বোধন করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন প্রায় সব কাজই শেষ। তাছাড়া এটা হলো দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এখন টুকিটাকি যে কাজগুলো আছে সেগুলো চলমান আছে।’মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতু এলাকায় দেখা গেছে কর্মযজ্ঞ। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে দিনরাত কাজ চলছে। রোড মার্কিংয়ের কাজ করছেন শ্রমিকরা। ১০ দিনের মধ্যে এ কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সেতুর দুই পাশে লাইটিংয়ের কাজও চলছে। কয়েক দিনের মধ্যেই এ কাজ শেষ হবে। তাছাড়া উদ্বোধনের জন্য চলছে ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ। সেতুর টোল প্লাজার কাজও শেষের দিকে। এখন পরিষ্কার করা হচ্ছে টোল প্লাজার চারপাশ। রেলসেতুর কাজও চলছে। সেতুর আশপাশের এলাকায় তৈরি হয়েছে নতুন রেস্তোরাঁ। গত ঈদুল ফিতরের সময় থেকেই সেতু দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন অনেকেই।পদ্মার পাড়ে গড়ে ওঠা ‘হক কিচেন রেসিডেন্ট মাওয়া’ নামে রেস্তোরাঁর ইনচার্জ মো. ইমরান বলেন, ‘আমাদের বেচাকেনা বেড়েই যাচ্ছে। আগের থেকে তিনগুণ বেচাকেনা বেড়েছে। এ রেস্টুরেন্টে বসে খুব ভালোভাবেই পদ্মা সেতু দেখা যায়, যার জন্য ঢাকা থেকে মানুষ এখানে খেতে আসছে। সেতু উদ্বোধন হলে ভিড় আরও বাড়বে। তাছাড়া আমাদের দেখে এখানে আরও তিনটি রেস্টুরেন্ট হয়েছে। সামনে আরও বাড়বে।’ কিন্তু পদ্মা সেতু না হলে কখনো এখানে রেস্টুরেন্ট হতো না বলে মনে করেন তিনি।লিটন খান নামে পদ্মাপাড়ের এক ভ্রাম্যমাণ দোকানি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও ঢাকায় হকারি করেছি। এখন এই পদ্মা সেতু হওয়ায় নদীপাড়ে প্রতিদিন মানুষ ঘুরতে আসছে। এখন এখানেই ভ্রাম্যমাণ দোকান দিয়েছি। বিকালের পর এখানে খাবার অনেক বেচাকেনা হয়। পদ্মা সেতু হওয়ায় এখন গ্রামেই পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে আছি।’জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহাদুজ্জামান মুন্না বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে আমাদের বরিশালের মানুষ সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করবে। এখন থেকে ফেরির জন্য ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না। আগে ঈদের সময় আসলে ফেরির জন্য মানুষ কতটাই না সমস্যায় পড়ত। এখন থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে পারাপার হওয়া যাবে; যা কখনো কল্পনাও করা যেত না।’সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী বৃহস্পতিবার সেতুতে গাড়ির ট্রায়াল রান হবে। জুনের ১৫ তারিখের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। উদ্বোধন হওয়ার পরও টুকিটাকি যে কাজ বাকি থাকবে সেগুলো করা হবে। সরকারের নির্ধারণ করা টোলের হার অনুসারে বর্তমানে ফেরিতে পদ্মা নদী পার হতে যে টাকা লাগে, সেতু পার হতে এর চেয়ে গড়ে দেড়গুণ বেশি টাকা খরচ করতে হবে।ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর টোল আদায়কারী ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগ করেছে সেতু বিভাগ। এ কাজ পেয়েছে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। এর মধ্যে এমবিইসি মূল সেতুর নির্মাণকাজ এবং কেইসি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। আগামী পাঁচ বছরের জন্য এ দুটি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দুই প্রান্তে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতু ও নদীশাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য পাঁচ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুসারে গত সোমবার পর্যন্ত মূল সেতুর কাজ এগিয়েছে ৯৮ শতাংশ। নদীশাসনের কাজের অগ্রগতি ৯২ শতাংশ। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় সেতুর প্রথম স্প্যান। ওইদিন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উপস্থিতিতে বসানো হয় স্প্যানটি। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সে সময় ছিলেন সেতু বিভাগের সচিব। ৪২টি পিলারের ওপর ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থের দেশের সবচেয়ে বড় এ সেতু এখন প্রস্তুত। সেতু নির্মাণের প্রয়োজনে অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৯১৮ হেক্টর জমি। শুরুতে বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন, এটি নির্মিত হলে বাংলাদেশের জিডিপিতে এর অবদান হবে ১ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু খুলে দেওয়ার প্রাক্কালে অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণে জিডিপিতে পদ্মা সেতুর অবদান দাঁড়াবে ২ শতাংশ।পদ্মা সেতু মুন্সীগঞ্জের লৌহজংকে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশ সংযুক্ত হয়েছে এ সেতুর মাধ্যমে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে রয়েছে একটি একক রেলপথ।২০০৬-০৭ সালে প্রকল্প প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। একই পথ অনুসরণ করে অন্য দাতারা। দুর্নীতির অভিযোগে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সচিব মোশারেফ হোসেন ভূঁইয়াকে জেলেও যেতে হয়েছিল। পরে অবশ্য অভিযোগের কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয়।সর্বশেষে প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়ন করা হয়েছে। এইসিওএমের নকশায় পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পরে ব্যয় আরও ৮ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। সেতু নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু র্কর্তৃপক্ষ।

আরও খবর

🔝