শিরোনাম |
মিশরের অধিবাসী কিবতিদের রাজাকে সাধারণত ‘ফেরাউন’ বলা হতো। এই পদবী ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, কিন্তু সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফেরাউন নিজেকে খোদার সমতুল্য বা সর্বশক্তিমান মনে করতেন। তিনি শুধুমাত্র মিশরীয়দের শাসকই ছিলেন না, বরং তাদের উপরে জুলুম চালানোর ক্ষমতাও তার হাতে ছিল। আল্লাহ তাআলা নবী হজরত মুসা (আ.)-কে নবুয়্যত দান করে তাকে ফেরাউনের কাছে প্রেরণ করেন, যাতে তিনি ফেরাউনের ঔদ্ধত্য ও শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সত্যের দাওয়াত দিতে পারেন এবং মানুষকে তাওহিদ বা একত্ববাদের পথে আহ্বান জানাতে পারেন।
হজরত মুসার (আ.) সময়কার ফেরাউনের প্রকৃত নাম নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেক ইসলামী ঐতিহাসিক এবং গবেষকরা দাবি করেন, ফেরাউনের নাম ‘রামেসিস’ ছিল। আবার কেউ বলেন, নবুয়্যত লাভের পর তিনি ‘মারনেপতাহ’ নামে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও ‘ওয়ালিদ ইবনে মাসআব ইবনে রাইয়ান’ নামক ফেরাউন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, যিনি প্রায় চারশত বছর বেঁচে ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে বনি ইসরাইলের ওপর জুলুম চালিয়েছিলেন।
এতসব বিভিন্ন নামের মাধ্যমে বোঝা যায়, ফেরাউনের ক্ষমতা ও শাসন ব্যবস্থা কেমন ছিল, এবং তিনি কিভাবে বনি ইসরাইলকে দমন ও শোষণ করতেন।
আরও পড়ুন...
পবিত্র আশুরা: ইতিহাস, তাৎপর্য ও ইসলামসম্মত করণীয়-বর্জনীয়
কোরআন ও হাদিসের বর্ণনায় জানা যায়, মুসার (আ.) জন্মের আগেই ফেরাউন একটি ভবিষ্যদ্বাণী শুনেছিলেন, যা তাকে আতঙ্কিত করেছিল। ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা হয়েছিল, বনি ইসরাইলের এক নবজাতক ছেলে তার শাসনকাল শেষ করবে। ফলে ফেরাউন ভয় পেলেন এবং বনি ইসরাইলের ছেলে শিশুদের হত্যা শুরু করলেন।
সুরা বাকারা (আয়াত ৪৯) এ ঘটনার কঠোর বর্ণনা দিয়েছে: “স্মরণ কর, আমি যখন তোমাদের ফেরাউন গোষ্ঠী থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম, যারা তোমাদের ছেলে সন্তানদের হত্যা করে আর মেয়েদের জীবিত রেখে তোমাদের মর্মান্তিক যাতনা দিত...”
এমন নিষ্ঠুরতার কারণে বনি ইসরাইলের পরিবারে বিপদ নেমে এসেছিল। তাদের জন্য এটি ছিল এক মহান পরীক্ষা ও ধৈর্যের পরিক্ষা।
মুসার (আ.) জন্মের পর তার মা আল্লাহর নির্দেশে তাকে নদীতে ভাসিয়ে দেন যাতে ফেরাউন ও তার সেনারা তাকে খুঁজে না পায়। আল্লাহর হেফাজতে, শিশুটি ফেরাউনের রাজপ্রাসাদে পৌঁছে এবং সেখানে তাকে লালন-পালন করা হয়। রাজপ্রাসাদের বায়ুমণ্ডলে বড় হয়ে ওঠা মুসা (আ.) ছিলেন মিশরের এই ক্ষমতাধর পরিবেশের একজন অংশ, কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনায় তিনি পরবর্তীতে বনি ইসরাইলের মুক্তির মহান নবী হিসেবে প্রেরিত হবেন।
যুবক বয়সে মুসার (আ.) হাতে এক দুর্ঘটনাজনিত হত্যাকাণ্ড ঘটে, যার ফলে তিনি মিশর ত্যাগ করে মাদায়েনে যান। সেখানে তিনি প্রায় দশ বছর কাটান। মাদায়েনে সময় কাটানোর পর যখন তিনি স্ত্রীসহ ফের ফিরে আসছিলেন, পবিত্র তুয়া উপত্যকায় আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুয়্যতের ওহি নাজিল হয়।
আরও পড়ুন...
কর্মস্থলের দায়িত্ব : কাজে অবহেলা গুনাহর শামিল
নবুয়্যত লাভের পর মুসা (আ.) আল্লাহর আদেশে ফেরাউনের কাছে যান এবং তাকে একত্ববাদের দাওয়াত দেন। মুসা (আ.) ফেরাউনের ঔদ্ধত্য ও অহংকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, ফেরাউন, তুমি একজন মানুষ, আল্লাহ একমাত্র খোদা। কিন্তু ফেরাউন তার অহংকারে লিপ্ত থেকে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজেকে খোদার সমতুল্য দাবি করে যুলুম চালিয়ে যান।
ফেরাউনের এই অবজ্ঞা ও ঔদ্ধত্যের কারণে আল্লাহ তাকে কঠিন শাস্তি দেন।
মুসা (আ.) বনি ইসরাইলকে মিশর থেকে মুক্তি দিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে ফেরাউন তাদের পিছনে ধাওয়া করেন। আল্লাহর ইচ্ছায়, লোহিত সাগর দুই ভাগ হয়ে বনি ইসরাইলের জন্য মুক্ত পথ সৃষ্টি করে, আর ফেরাউন ও তার বাহিনী সাগরে ডুবে যান।
কোরআনে সুরা ইউনুস (আয়াত ৮৮-৯২) এ ঘটনাটি বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে: “আমি বনি ইসরাইলকে সাগর পার করে দিলাম আর ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনী তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলো। যখন তারা ডুবতে আরম্ভ করল, তখন ফেরাউন বলল, ‘এবার বিশ্বাস করি, তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই...’ কিন্তু আল্লাহ বললেন, ‘তুমি (ডুবতে শুরু করার) পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত নাফরমানি করছিলে...’”
নবি মুসার (আ.) জীবনের এই সংগ্রাম, ফেরাউনের ঔদ্ধত্যের বিপরীতে আল্লাহর সাহায্য, এবং বনি ইসরাইলের মুক্তির ঘটনা ইসলামী ইতিহাসে এক মহান শিক্ষা ও ঈমানের প্রতীক।
১০ মহররমের পবিত্র আশুরার দিন মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের মুক্তির দিন হিসেবে পরিচিত। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনার ইহুদিদের আশুরার রোজা পালন দেখতে পেয়ে তার তাৎপর্য জানতে চান। তখন জানা যায়, এটি সেই দিন, যেদিন আল্লাহ নবী মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এরপর তিনি নিজেও এই রোজা পালন শুরু করেন এবং মুসলমানদেরও পালন করার নির্দেশ দেন (সহিহ মুসলিম: ২৫৪৮)।
মিশরের ফেরাউন ও নবী মুসার (আ.)-এর কাহিনী কোরআনে বহু স্থানে বর্ণিত এবং মুসলিম ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি আমাদের শেখায়, যে ঔদ্ধত্য ও জুলুম কখনো টিকে থাকতে পারে না, আল্লাহ তাআলার সাহায্য ও পরিকল্পনা সর্বদাই সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকে। নবী মুসার (আ.)-এর সংগ্রাম ও দাওয়াতের মাধ্যমে আমরা বিশ্বাস, ধৈর্য এবং আল্লাহর প্রতি ভরসার মহান শিক্ষা পাই।