gramerkagoj
বৃহস্পতিবার ● ১৭ জুলাই ২০২৫ ২ শ্রাবণ ১৪৩২
gramerkagoj
বর্ষারাণী তুমি ছুঁয়ে যাও
প্রকাশ : শনিবার, ৫ জুলাই , ২০২৫, ০৯:৪২:০০ পিএম
অধ্যাপক মোঃ মসিউল আযম:
GK_2025-07-05_68694837493c1.jpg

ষড় ঋতুর দেশ, আর বৈচিত্র্যের লীলাভূমি আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ঋতু চক্রে গ্রীষ্মের পরই বর্ষার স্থান। গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপে গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ-পশু পাখি যখন ছটফট করতে থাকে তখন মহান আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় রহমত হিসেবেই বৃষ্টি ধারা এ পৃথিবীর মাঝে বর্ষিত হয়। তাই বর্ষাকাল আমাদের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ। এ ঋতু না হলে বাংলার ধান ক্ষেতে ফসলের সবুজ সম্ভার আসত না। প্রকৃতি আবার নতুন পাতার ঘাঘরা পরে বালিকার মত পায়ে নূপুর বাজিয়ে নেচে উঠত না। আর এই সবুজের সতেজ প্রাণ তো নবীণ প্রাণের। তাই বর্ষাকাল সবচে জীবন্ত ঋতু। আমার প্রিয় ঋতু। বর্ষার আগমনে বাংলার ঋতুতে যে পরিবর্তন আনে অন্য কোন ঋতুতে তা আনতে পারে না। অন্য ঋতু উত্তরণ ঘটায় নীরবে। আর পল্লী প্রকৃতিতে বর্ষা নিয়ে আসে যৌবনের উদ্দামতা। বৃষ্টি ভেজা সকাল, গাছের সবুজ পাতা, বর্ণময় ফুল, আর মেঘের আনাগোনা, লুকোচুরি খেলা দেখার মজাই আলাদা। বর্ষায় কদম, কেয়া, যুই চামেলী, বকুলসহ রকমারী ফুলের সম্ভার প্রকৃতিকে করে তোলে রূপরানী।
তাই মধ্যযুগ থেকে এই কাল পর্যন্ত এমন কোন গীতি কবি নেই যার রচনায় বর্ষার প্রসঙ্গ আসেনি। বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন চর্যাপদেও নদী, নৌকা, বর্ষা, বৃষ্টির কথা আছে। বর্ষার অসাধারণ সৌন্দর্যে পাগল হয়ে রবীন্দ্রনাথ মায়ের কোলে বসেই বলে উঠল “জল পড়ে পাতা নড়ে”। রূপকথার শিশু রবীন্দ্রনাথের প্রথম অনুভবের কথা। তার বর্ষার গানগুলি পড়লে বোঝা যায় তা হৃদয়ের গভীরে নাড়া দেয়। জীবনের সম্ভাবনার অরূপ চির নতুনের বন্দনা ।
এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভূবন ভরসা।।
প্রত্যেক ঋতুকে নিয়েই বরীন্দ্রনাথের কিছু সৃষ্টি কর্ম রয়েছে। কিন্তু বর্ষাকে নিয়ে রয়েছে সবচেয়ে বেশি কী গান, কী কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে বর্ষার রূপায়ন। আর গানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হল বর্ষার গান। তিনি যেন প্রকৃতিতে কান পেতে শোনেন বৃষ্টির বাজানো নূপুর ঃ
গহন রাতে শ্রাবণ ধারা পড়িছে ঝরে,
কেন গো মিছে জাগাবে ওরে।।
এখনো দু’টি আঁখির কোনে যায় যে দেখা জলের রেখা
না-বলা বানী রয়েছে যেন অধর ভরে।
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানগুলি পড়লে বোঝাযায় তা হৃদয়ের কতটা গভীরে নাড়া দেয়। সে সুর কোন সময় শোনা যায় কোন কোন সময় তা অন্তরেই রয়ে যায়।
“বাদল দিনের দীর্ঘ শ্বাসে জানায় আমার ফিরবে না সে
বুক ভরে যে নিয়ে গেল বিফল অভিসার”
বর্ষাই কবি মনকে ছন্দ দেয়, দোলা লাগায় ভাবিয়ে তোলে কবি করে তোলে ।
“মোর ভাবনারে কী হওয়ার মাতানো,
দোলে মন দোলে অকারন হরষে
হৃদয় গগনে সমল নবীন মেঘে
রসের ধারা বরষে।
কবি এই শ্রাবনের মোহিনী জলে স্নান করেন, লাভ করেন অমৃত স্বাদ। মুছে ফেলেন সমস্ত জরাজীর্ণ আর পুরাতনের অভিশাপ। তিনি তাই হয়ে ওঠেন চির নতুন অনাদি কালের। অসীম সুর বর্ষার নবীন প্রাণের মত সব প্রেমই তার হৃদয়ে বারবার ঝংকার তোলে-
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।
কবি গুরুর বর্ষা নিয়ে আরেকটি হৃদয়গ্রাহী সংগীত-
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগল আমার মন নেচে ওঠে।
এমন অসংখ্য গান আমরা শুনছি যুগ যুগ ধরে, কালের যাত্রায়, শুনব কালান্তরে।
কাজী নজরুল ইসলামও বর্ষা নিয়ে লিখেছেন-
বরষা ওই এল বরষা
অঝোর ধারায় জল, ঝরঝরি অবিরল
ধূসর নীরস ধরা হ'ল সরসা।
অথবা,
আদর গরগর
বাদর দরদর
এ, তনু ডর ডর
কাঁপিছে থর থর
নয়ন ঢল ঢল
কাজল কালোজল
ঝরে লো ঝর ঝর।
কবি বেগম সুফিয়া কামালের-
আমি বর্ষা আসিলাম গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি,
মায়ার কাজল চোখে, মমতায় বর্মপুট ভরি।
আর তখনই তো গেয়ে ওঠা সম্ভব,
হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে।
হয়তো তখনই মনে হয় বহুবাঞ্জিতা প্রিয়াকে
বলা যায় মনের কথাটি,
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘোর বরিষায়,
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়।
ষাটের দশকে আমাদের বিনোদনের একটিই মাধ্যম ছিল রেডিও। সেকালে টেলিভিশন এত সহজলভ্য হয়নি। কোলকাতা বেতারে প্রতি সপ্তাহে রবিবার দুপুর-১-৩ মিঃ হতে ২টা পর্যন্ত নিয়মিত ভারতীয় শিল্পী মন-প্রাণ ছুঁয়ে যাওয়া গানগুলো প্রচারিত হতো। আমি ছিলাম সেই গানের একনিষ্ঠ ভক্ত। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সেই গানের কলি আমার এখনও প্রাণে বাজে।
যশোর শহরের মুসলিম একাডেলীর পাশে বকুলতলার একটি সেলুন। রবিবার দিন এলেই মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়েও সেখানে বসে শুনতাম গান।
“তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো,
অনেক দিনের এলোমেলো কথা যেন মনে হলো
“মন কারে যেন চায়, এই রিমঝিম, রিমঝিম শ্রবণ ধারায়।
“আষাঢ, শ্রাবণ মানে না তো মন, ঝরঝর করিছে
তোমাকে আমায় মনে পড়িছে!
কোন কিছু উপহার দিয়োনা আমার
সন কিছু পাওয়া হবে পেলে গো তোমার!
“এলো বরষা যে সহসা মনে তাই,
এই রিমঝিম, ঝিম গান গেয়ে যায়
গানেরই ধারা মাঝে, প্রাণেরও কথা আছে।
“এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে- থাকে না মন,
কবে যাবো, করে পাবো তোমার নিমন্ত্রণ?
“বৃষ্টি বিষ্টি বৃষ্টি
এ জীবন হলো মিষ্টি
এ কোন অপরূপ সৃষ্টি
কেন এত যে মিষ্টি।
‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম ছুটি
শ্রাবণ সন্ধ্যা তোমার কাছে
চেয়ে নিলাম
‘হৃদয়ের জানালায় চোখ মেলে রাখি’।
“ আকাশ এতো মেঘলা
যেও নাকো একলা,
এখনই নামিবে অন্ধকার,
ঝড়ের জল তরঙ্গে
নাচরে নটী রঙ্গে
ভয় আছে পথ হারাবার।
বর্ষা নিয়ে শিল্পীদের এমনি অসংখ্য গান আছে। পরিশেষে জীবনের শেষ প্রান্তে পড়ন্ত বেলায় নিরিবলি একাকী যখন বসে থাকি, স্বপ্নীল দিনের সেই গানের কলি যখন মানস পটে ভেসে উঠে। মাঝে মাঝে শিল্পীদের গাওয়া সেই কন্ঠ সুর মিলিয়ে কিছুটা আনন্দ অনুভব করি। তাই আমি মনে করি, আমি যা দেখেছি, যা পেয়েছি আমার জীবন সার্থক; জীবন ধন্য।
এ জন্যে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে লাখো শুকরিয়া।

লেখক ঃ অধ্যাপক মোঃ মসিউল আযম
প্রবীন সাংবাদিক, কলাম লেখক ও উন্নয়নকর্মী
মোবা-০১৭১২-১১৬৩৭২

 

 

আরও খবর

🔝