শিরোনাম |
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুরুষ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—যার জন্ম, কর্ম, দর্শন ও সাহিত্য আজও আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। কিন্তু ক’জনই বা জানেন, কবির পূর্বপুরুষদের আদি বসতভিটা ছিল খুলনার এক নিভৃত গ্রামে—পিঠাভোগে? সেই পিঠাভোগ আজ আর শুধু একটি গ্রাম নয়, হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের শিকড় সন্ধানের এক ঐতিহাসিক কেন্দ্রবিন্দু।
খ্রিষ্টীয় অষ্টম-একাদশ শতকে বঙ্গদেশে হিন্দুধর্ম পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কান্যকুব্জ থেকে আগত পঞ্চ ব্রাহ্মণের একজন ছিলেন শাল্ল্যি গোত্রীয় ক্ষিতিশ। তার বংশধর দ্বীননাথ কুশারী পরবর্তীতে কুশারী গোত্রে অন্তর্ভুক্ত হন এবং বসতি গড়েন খুলনার পিঠাভোগ গ্রামে। এখানেই জন্ম নেন জগন্নাথ কুশারী—যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি পুরুষ।
জগন্নাথ কুশারীর পুত্র পঞ্চানন কুশারী ভাগ্যান্বেষণে কলকাতার গোবিন্দপুরে গমন করেন। স্থানীয় লোকেরা তাকে ‘ঠাকুর’ নামে সম্বোধন করতে শুরু করে, যেখান থেকে ঠাকুর উপাধির সূচনা হয়। এভাবেই কুশারী থেকে ঠাকুর নামের বিবর্তন ঘটে।
আরও পড়ুন...
জুলাই মাসেই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত হতে পারে
পিঠাভোগে জন্ম নেওয়া কুশারী বংশদর জগন্নাথ কুশারী বিবাহ করেন দক্ষিণডিহির রায় চৌধুরী পরিবারের কন্যাকে। এতে পীরালী ব্রাহ্মণ হিসেবে জাতিচ্যুত হয়ে তাকে শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণডিহিতেই স্থায়ী হতে হয়। তার বংশধর পঞ্চানন কুশারী কলকাতায় পাড়ি জমান এবং গোবিন্দপুরে ‘ঠাকুর’ নামে খ্যাত হন। এখান থেকেই ঠাকুর বংশধারা প্রবাহিত হয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্তত দুইবার খুলনায় এসেছিলেন। প্রথমবার ১৯০০ সালে বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের নিমন্ত্রণে, এবং দ্বিতীয়বার ১৯০৮ সালে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সাক্ষ্য দিতে। যদিও তিনি কখনও পিঠাভোগে যাননি, তথাপি তার পত্রাবলীতে স্পষ্টভাবে তার খুলনা সফরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
তিনি খুলনা অবস্থানকালে যে সরকারি মামলায় সাক্ষ্য দেন, সেখানে তার বক্তব্য স্বাধীনতা, কবিতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের পক্ষে ছিল। সরকারের পক্ষে সাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাহসিকতার সঙ্গে নিজের মতপ্রকাশ করেন।
আরও পড়ুন...
জোহরান মামদানিকে গ্রেপ্তার হুমকি ট্রাম্পের
১৯৯৫ সালে সাংবাদিক অরুণ শীল কুশারীর উদ্যোগে কবির আদি নিবাস সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত হয়। জেলা প্রশাসক ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় পিঠাভোগে কুশারী বাড়ির জমি অধিগ্রহণ করে নির্মাণ করা হয় রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা ও কবির ভাস্কর্য।
২০১১ সালে প্রত্মতাত্ত্বিক খননও শুরু হয়। তবে এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে কবির আদি ভিটা সংরক্ষণের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
পিঠাভোগ গ্রাম এখন শুধুই রবীন্দ্রনাথের আদি নিবাস নয়, এটি এক ঐতিহাসিক নিদর্শন, যা আমাদের পূর্বপুরুষের শিকড় খুঁজে পাওয়ার জায়গা। কুশারী পরিবারের এই ইতিহাস কেবল ঠাকুর পরিবারের নয়, গোটা বাংলারই।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ বিশ্বসাহিত্যের অংশ। কিন্তু তার আত্মপরিচয়ের একটি মূর্ছিত অংশ খুলনার পিঠাভোগ গ্রামে। এই গ্রামকে নতুন করে আবিষ্কার করা মানে কেবল একটি আঞ্চলিক ইতিহাসকে খোঁজা নয়, বরং রবীন্দ্র-চেতনার সঙ্গে আবার একবার আমাদের আত্মিক সংযোগ গড়ে তোলা।