প্রকাশ: রোববার, ৭ মে, ২০২৩, ৮:১৮ পিএম |

ঊর্ধ্বগতি শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। ঊর্ধ্বগতি যদি সাফল্যের হয় নিশ্চয় তা গৌরবের বা আনন্দের। উন্নয়নের ঊর্ধ্বগতি, পরীক্ষার ফলাফলে পাসের ঊর্ধ্বগতি, আরও অনেক ঊর্ধ্বগতি আমাদের আপ্লূত করলেও সড়কে প্রাণহানীর সংখ্যার যে ঊর্ধ্বগতি আর বাজারে দ্রব্যমূল্যের বিদ্যুৎবেগে চলমান ঊর্ধ্বগতি মানুষকে সমানভাবে ভূপাতিত করছে! সড়ক- মহাসড়কের উন্নয়নের ঊর্ধ্বগতি যদি প্রাণহানির ঊর্ধ্বগতি থামাতে না পারে বরং বাড়িয়ে তোলে তাহলে সেই উন্নয়ন জনসংখ্যা কমানোর কাজে সহায়ক মনে হতে পারে। প্রতিদিন পত্রিকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা আমাদের তেমনই স্মরণ করিয়ে দেয়। যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।
দ্রব্যমূল্যের চলমান ঊর্ধ্বগতির কথা লিখে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব, কারণ কেনটা রেখে কোনটার কথা লিখবে! প্রতিটি জিনিসের দাম আজ থেকে কাল বেড়েই চলেছে। এক অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মধ্যে মানুষ জিম্মি হয়ে আছে। এ যেন এক মগের মুল্লুক, ইচ্ছে মতো যে কোনো জিনিসের দাম বাড়ানো যায়, একবার বাড়লে তা আর কমে না। কমে না বললে ভুল হবে, এখানেও চলে আরেক মজার খেলা। কোনো জিনিসের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে তারপর ঘটা করে দুএক শতাংশ হয়তো কমানো হয়! যেমন সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি দাম ছিল একশো টাকার কম, সেটা দুইশো টাকা বাড়িয়ে এরপর আয়োজন করে দশটাকা কমানো হলো। এরকম আরও অনেককিছুর দাম নিয়ে হাস্যকর সব কা- কারখানা চলে এদেশের সাধারণ মানুষের সাথে। এলপি গ্যাসের পর্যাপ্ত মজুদ আমাদের দেশে আছে বলেই জানি, তারপরও নিত্যদিন এর দাম নিয়ে টানাহেঁচড়া চলে। এতদিন শুনে আসছি সুগারমিলগুলো সব লোকসানে জর্জরিত। বস্তা বস্তা চিনি নষ্ট হয়, বাজারজাত হচ্ছে না। দেশি চিনি মানুষ কিনতে চায় না। আমরা প্রচারও করি দেশি চিনিতে উপকার বেশি, মিষ্টি বেশি। আমরা দেশি চিনি কিনব। দেশি 'পণ্য কিনে হও ধন্য" ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ কোথায় গেল চিনি? চিনির কেজি ১৪০ টাকা। আমাদের দেশে আখ উৎপাদন হয়। এতগুলো সুগারমিল, এত এত উৎপাদন, তাহলে গুদামজাত দেশি চিনি গেল কোথায়? হঠাৎ করে চিনির দাম আকাশচুম্বী হওয়ার কারণ মানুষের বোধগম্য নয়। চিনির দাম বাড়লে মিষ্টিজাতীয় সকল খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে, আরও বাড়তে থাকবে। এরকম প্রতিটা জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেকে হয়তো সাবলীল সুরে বলবেন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। মানুষ কিনছে, কোনো জিনিস পড়ে তো থাকছে না। বিষয়টা এমন সহজ না, কিছু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে ঠিকই সাধারণ মানুষ চোখে সর্ষেফুল দেখছে। আর একটা ব্যাপারও আছে, আমাদের সামাজিকতার ধরণ এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে পরিবার পরিজন নিয়ে সামাজিকতা রক্ষা করে চলতে গেলে লোকদেখানো চাকচিক্য বজায় রাখতে হয়! এটাও একধরনের প্রহসনের পর্যায়ে পড়ে যা করতে বাধ্য হই আমরা। ভিতরের অবস্থা যা-ই হোক পোশাকিভদ্রতা করতে না পারলে এই সমাজে টিকে থাকা কঠিন। সামাজিক মান বজায় রাখতে চাহিদা সাধ্যকে অতিক্রম করছে ক্রমাগত। এখনকার ছেলেমেয়েরাও অনেক বেশি ফ্যাশন সচেতন। তাদের দু-এক সেট জামাকাপড়ে এখন আর চলে না, তাছাড়া সন্তানদের লেখাপড়ার খরচও তথৈবচ। অর্থাৎ খেয়ে-পরে, সংসার চালিয়ে, সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করে একটি সাধারণ পরিবারের টিকে থাকা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে বা উৎপাদন সংকটের জন্য যে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি হয় সেটা মানুষ কষ্ট হলেও মেনে নেয়। তবে সেই কারণ জনগণের কাছে পরিষ্কার ও সহজবোধ্য হতে হবে। সাধারণ মানুষ দেশের অর্থনীতি, ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ড, মূল্যস্ফিতি এসব বোঝে না, বোঝার দায়ও তাদের নেই। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে দুবেলা দুমুঠো খেয়েপরে বাঁচতে চায়। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চায়। চায় সুষ্ঠু শান্তিময় পরিবেশ, স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা। সমাজের যারা খুব সাধারণ জনগণ, তাদের ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে এই চাওয়াটুকুই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেমন অনেক কিছু আশা করে না, রাজনীতি, অর্থনীতি বোঝে না, তাদের প্রাপ্য প্রাপ্তিটুকু পেলেই খুশি হয়ে যায়-- তেমন দিনান্তের এই ভোগান্তি, রাস্তায় বেরিয়ে বেঁচে ফেরার অনিশ্চয়তা, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা তাদের অসহায় করে তোলে। সমষ্টিগত অর্জন তখন চোখে পড়ে না। আমাদের অনেক প্রাপ্তি আছে, অনেক ক্ষেত্রেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়নের সূচক যতই ঊর্ধ্বমুখী হোক দিনশেষে এক-একটি পরিবারের স্বস্তিপূর্ণ মুখের হাসির সম্মিলিত রূপই শান্তিপূর্ণ একটি দেশ। পরিবারের একজন মানুষের ক্ষতি যেমন পুরো পরিবারকে অশান্ত করে তেমনি দ্রব্যমূল্যের এই টালমাটাল অবস্থা, অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা সহ সকল অসংগতিগুলো সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনকে ম্লান করে দিতে যথেষ্ট বলে মনে হয়। জনজীবনে নিশ্চয়তা ফিরিয়ে আনতে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার বোধ হয় এখনই সময়।