সোমবার ৫ জুন ২০২৩ ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
                
                
☗ হোম ➤ মতামত
যদুনাথ মজুমদার
কাজী শওকত শাহী
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২২, ১:০২ এএম |
কিংবদন্তী পুুরুষ, সমাজ দিতৈষী বিদ্যুৎশাহী, বাগ্মী, সুসাহিত্যিক প্রথিতযশা আইনজীবী যদুনাথ মজুমদার ১৮৫৯ সালের ২৩ অক্টোবর তৎকালীন যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার লোহাগড়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম তারাপ্রসন্ন মজুমদার এবং মাতা পথতাননী। লোহাগড়ার মত একটি সাধারণ স্থানে ও সাধারণ বৈশ্য বায়জীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সমাজ উন্নয়নে এবং শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি যে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন তা ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে আছে।
যদুনাথ মজুমদারের লেখাপড়ার সূচনা হয় লোহাগড়ার নিজ এলাকার স্কুলে। পরবর্তী সময়ে তিনি শিক্ষা অর্জনের  জন্য  নড়াইলে চলে আসেন। এখানকার স্কুল থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কলকাতার শিক্ষাজীবনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। যদুনাথ মজুমদার ফ্রি চার্চ কলেজ, ক্যানিং কলেজ এবং লাক্ষেèৗতেও পড়াশুনা করেন। ১৮৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। এছাড়াও তিনি বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, উর্দু, হিন্দি ও ফার্সি ভাষায় ছিলেন সুপন্ডিত। 
শিক্ষাকতার মধ্যদিয়ে তিনি তাঁর কর্মজীবন সূচনা করেন। কলকাতায় পন্ডিত বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত  সংস্কৃত কলেজে যদুনাথ মজুমদার কিছুদিন অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীকালে নেপালের তৎকালীন শাস্ত্রী স্যার মহারাজ রণদীপ সিংহ বাহাদুরকে সি.সি.এম.আই-এর অনুরোধে তিনি নেপালের কাঠমুন্ডু স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে নেপালে রাজনৈতিক গোলযোগ দেখা দিলে উক্ত স্কুল থেকে শিক্ষকতা পরিত্যাগ করেন। কিছুদিন পরে তিনি কাশ্মীরের রাজস্ব সচিবের পদে যোগদান করেন। অল্পকিছু দিন এই চাকরি করার পর ঐ চাকরি ছেড়ে দিয়ে বি.এল পরীক্ষা দেন এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
এবার তিনি যশোরে ফিরে এসে আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন এবং যশোর কোর্টে ওকালতী আরম্ভ করেন।  অল্প দিনের মধ্যেই তিনি একজন নামকরা আইনজীবী ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সবিশেষ পরিচিতি লাভ করেন।
তখনকার তরুণ উকীল রায়বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার বেদান্তবাচস্পতি এম.এ.বি.এল নীল বিদ্রোহের সময় প্রথম থেকেই প্রজাদের পক্ষে দন্ডায়মান হতেন। স্টিভেনসন সুর জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এ সময় ঝিনাইদহে আসেন, তিনি প্রজাদের নামে অসংখ্য মোক্কদ্দমা করে তাদেরকে শাস্তি দিতে  লাগলেন। শত শত প্রজা জেলে গেলেন। এই সকল মামলার প্রজাপক্ষের উকিল হলেন যদুনাথ মজুমদার। তিনি শুধুমাত্র প্রজার পক্ষে স্বল্প বা বিনাস্বার্থে ওকালতি করতেন না, প্রজার পক্ষে সংবাদপত্রে লেখা, গভর্মেন্টর নিকট দরখাস্ত করা সকল কিছুই যদুনাথ মজুমদার করতেন। 
যদুনাথ মজুমদার গরবি প্রজাদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপন করার ব্যবস্থা করেন। পার্লামেন্ট এ কারণে ভারত সরকারের কাছে ফেফিয়ৎ তলব করেন। তখন থেকেই নীলকর অত্যাচার প্রশমিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়।
স্বদেশী আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল উলে¬খযোগ্য। স্বদেশীদের বৃটিশ কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি নিঃস্বার্থভাবে বিনা পরিশ্রমে পক্ষে ওকালতি করতেন। 
এই সমাজ তিহৈষী ও সমাজসেবক যদুনাথ মজুমদার ১৯০৪ সাল থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার পালন করেন। তাঁর সময়েই পৌরসভার অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হয়।
এই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব যদুনাথ মজুমদার ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে তিনি ম্যালেরিয়া, কলেরা সংক্রমন রোগে আক্রান্ত যশোর জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। এই সকল রোগ থেকে মানুষকে সচেতন করার জন্য যদুনাথ মজুমদার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশকরে প্রচার করতেন। এছাড়াও “পল¬ী স্বাস্থ্য” নামক একখানি পুস্তিকা প্রকাশকরে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ে জ্ঞানদানের উপলক্ষ্যে পুস্তিকাটি প্রচার করতেন।
কিংবদন্তীতুল্য, শিক্ষাব্রতী অবিস্মরণীয় কৃতি মানুষ যদুনাথ মজুমদার শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন-যশোরবাসী তা চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে যাবে। ১৮৮৯ সালে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে তিনি যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করেন “সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন”। নিজ গ্রাম লোহাগড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন লোহাগড়া যদুনাথ একাডেমী (মধ্য ইংরেজী স্কুল)। যশোর জেলার অবহেলিত নারী সমাজের জ্ঞানদানের জন্য ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “মধুসূদন তারা প্রসন্ন বালিকা বিদ্যালয়”। ১৯১৪ সালে কেশবপুর থানায় যদুনাথ মজুমদার প্রতিষ্ঠা করেন “সুফলাকাটি বিদ্যালয়”। 
যশোর ইন্সটিটিউটের পথিকৃৎ যদুনাথ মজুমদার ১৯২৮ সালে যশোর পাবলিক লাইব্রেরী, নিউ আর্য থিয়েটার এবং টাউন ক্লাবকে একত্রিত করে গড়ে তোলেন যশোরের সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র “যশোর ইন্সটিটিউট”। তিনিই এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার পালন করেন। 
যদুনাথ মজুমদার কেবলমাত্র বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেই খ্যান্ত ছিলেন না। শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে করেছেন সহযোগিতা ও যুগিয়েছেন নিরন্তর অনুপ্রেরনা।
স্বনামধন্য জোতির্বিদ রাধাগোবিন্দর আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য যশোর কালেক্টরিতে চাকরি পেতে যদুনাথ মজুমদার  প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। এছাড়াও রাধাগোবিন্দকে একটি বাইনোকুলার উপহার দিয়ে তাঁর আকাশচর্চায় আগ্রহকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রাধাগোবিন্দ পরবর্তীকালে তাঁর এই অবদানের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ-তাঁর রচিত “ধুমকেতু” বইটি নিম্নলিখিত উৎসর্গ পত্রটি লিখে উৎসর্গ করেন- “কৈশোরে যাঁহার উৎসাহে নক্ষত্রবিদ্যা শিক্ষা ও গগন পর্যবেক্ষণের প্রথম সূচনা হয় সেই অশেষ গুণসম্পন্ন প্রজ্ঞা-শ্রী লাঞ্ছিত ললাট সৌম্যদর্শন রায়বাহাদুর স্বর্গত যদুনাথ মজুমদার, বেদান্তবাচস্পতি, এমএ, বিএল,সিআইই মহোদয়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই ক্ষুদ্র গ্রন্থ অর্পিত হইল।
যদুনাথ মজুমদার কেবলমাত্র একজন সমাজ হিতৈষী ও শিক্ষাব্রতী ব্যক্তিত্বই ছিলেন না। তিনি একজন সৃজনশীল সাহিত্যিকও ছিলেন। বাংলা ভাষায় তিনি “ধর্মতত্ত্ব”, “দর্শন”, “রাজনীতি”, “সমাজতত্ত্ব” ও “স্বাস্থ্যতত্ত্ব” বিষয়ে অনেক প্রকার গ্রন্থ রচনা করেন।  তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে-“অমিত্বের প্রসার”, “ব্রহ্মসূত্র”, “পরিব্রাজক”, “পরিব্রাজক সূক্তমালা”, সংখ্যাকারিকা”, “নবগাঁথা”, “শান্তিল্যসূত্র”, “শ্রেয় ও প্রেয়” উলে¬খযোগ্য।
তিনি ইংরেজি ভাষাতেও কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর শাত্তিল্যসূত্র গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের নিকট ব্যাপক সমাদৃত হয়। 
শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে যদুনাথ মজুমদারের অনন্য অবদানের জন্য ১৯১৫ সালে নেপালের মহারাজ তাঁকে কাইজার-ই-হিন্দ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯২১ সালে সরকারিভাবে এই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বকে রায়বাহাদুর এবং পরবর্তী সময়ে মি.আই.ই উপাধি প্রদান করা হয়।  
হিন্দুধর্ম শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিতের জন্য বর্ধমানের রাজার সভাপতিত্বে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁকে “বৈদান্তবচস্পতি ও বিদ্যাবারিধি” উপাধিতে সম্মানিত করা হয়। 
এই বরেন্য সমাজসেবক ও শিক্ষাব্রতী ব্যক্তিত্ব রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার ১৯৩২ সালের ২৪ অক্টোবর ৭৪ বছর বয়সে মাগুরা মহকুমার দয়ালপুর গ্রামে দেহত্যাগ করেন। 
# লেখক: অধ্যাপক, সাহিত্যিক ও গবেষক।



গ্রামের কাগজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন


সর্বশেষ সংবাদ
আ’লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ৯ জন
সড়কে দু’হাজার মেহগনি গাছ লাগিয়েছেন সাংবাদিক আব্দুর রহমান
দূষণের বড় কারণ পলিমার
তাপদাহে মরি মরি অবস্থা
জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বাপ্পী আটক
যশোরে দু’ বিচারকরে বদলি জনিত বিদায় সংবর্ধনা
মাকে মারপিট ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগে মামলা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় তেজ, প্রবল বৃষ্টির আশঙ্কা
হোয়াটসঅ্যাপে এই মেসেজ এলে সাবধান, ক্লিক করলেই সর্বনাশ
ভারতের উড়িষ্যায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৩শ, আহত ৯শ’
৯০ টাকার বিক্রি এখন মাসে ৫০ হাজার টাকা
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের পথে
ভাড়া ফ্ল্যাটে জাল টাকা তৈরি করতেন তারা
বারবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে পাইলটিং স্মার্ট স্কুল ঘোষণা
আমাদের পথচলা | কাগজ পরিবার | প্রতিনিধিদের তথ্য | অন-লাইন প্রতিনিধিদের তথ্য | স্মৃতির এ্যালবাম
সম্পাদক ও প্রকাশক : মবিনুল ইসলাম মবিন | সহযোগী সম্পাদক : আঞ্জুমানারা
পোস্ট অফিসপাড়া, যশোর, বাংলাদেশ।
ফোনঃ ০২৪৭৭৭৬২১৮০, ০২৪৭৭৭৬২১৮১, ০২৪৭৭৭৬২১৮৩ বিজ্ঞাপন : ০২৪৭৭৭৬২১৮৪, ই-মেইল : [email protected], [email protected]
কপিরাইট © গ্রামের কাগজ সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft