
রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার যোগীপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। যা মূলত বীরকুৎসা জমিদার বাড়ি বা বীরকুৎসা পরগণা নামে পরিচিত। উপজেলা সদর ভবানীগঞ্জ থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে বাগমারা সীমানার শেষ প্রান্তে যোগীপাড়া ইউনিয়নর বীরকুৎসা গ্রাম অবস্থিত। জমিদারবাড়ির পাশেই রয়েছে বীরকুৎসা রেলস্টেশন। ট্রেনে উঠে এই স্টেশনে নেমে ১০-১২ মিনিট হেঁটে অথবা অটোভ্যানে করে আসা যাবে জমিদার বাড়ীতে। নওগাঁর আত্রাই বা নাটোরের মাধনগর স্টেশনে নেমেও অন্য বাহনে করে পৌঁছানো যাবে আধঘণ্টার মধ্যে। এ ছাড়া বাসে করেও আসা যাবে। উপজেলা সদর ভবানীগঞ্জে নেমে অটোভ্যানে করে সরাসরি বীরকুৎসা হাজার দুয়ারি জমিদার বাড়িতে যাওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলো মিটার দূরত্ব বাস যাওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে।
নাটোর-সাস্তাহার রেলপথের পাশে ৫০ বিঘা জমির উপর এই জমিদার বাড়ি অবস্থিত। বাড়িটির এক সময়ে হাজারটি দুয়ার ছিল বলে এর নামকরণ করা হয় হাজার দুয়ারী। যথাযথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বাড়িটি। বেদখল হয়ে যাচ্ছে এখানকার মূল্যবান সম্পদও।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নওগাঁ জেলার আমরুল ডিহির রাজা গোপাল ধাম তার মেয়ে প্রভাতী বালাকে ভারতের কাশী থেকে আসা বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে বিয়ে দেন এবং তার অধীনস্থ এই বীরকুৎসা পরগণাটি মেয়ে প্রভাতী বালা ও জামাই বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে লিখে দেন। আর এই থেকেই এই জমিদার বাড়িটর জমিদারীর সূচনা হয়। প্রভাতী বালা ছিলেন খুবই শৌখিন। তাঁর পছন্দমতো স্বামী বিরুবাবু বীরকুৎসায় গড়ে তোলেন একটি সুরম্য অট্টালিকা। এর ছিল এক হাজারটি দুয়ার। এ কারণেই এটি হাজার দুয়ারি জমিদারবাড়ি। বর্তমানে নামে জমিদারবাড়ি পরিচিত।
হাজারদুয়ারী জমিদার বাড়ি দরজাগুলো পুরোনো ইটের গাঁথুনি, সুচার কারুকাজ, খসে পড়া পলেস্তারা ও শেওলাগজানো দেয়াল চোখে পড়বে। ওপরে ও নিচে দেখা যাবে অসংখ্য দরজা। এখনো আছে সেগুনকাঠের কারুকার্যখচিত দরজা। দরজাগুলো তিন স্তরে আবৃত ছিল। প্রথম স্তর কাঠে, দ্বিতীয় স্তর লোহার গ্রিলে ও শেষ স্তর দামি কাচে আবৃত ছিল। এখন কাচের দরজা আর নেই। শুধ রয়েগেছে এর চিহ্ন।
এ ছাড়া এই অট্টালিকার পুরো মেঝে ছিল শ্বেতপাথরে ঢাকা। তবে বেশির ভাগ শ্বেতপাথর চুরি হয়ে গেছে। প্রাসাদের সামনের ফুলের বাগানে জমিদার পরিবার বিকেলটা কাটাত। এখন সেই বাগান নেই। ফুলের বাগানের পরিবর্তে সেখানে দোকানপাট। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাগান দখল করে দোকানপাট বানিয়ে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুই ভাই দুর্গা বাবু ও রমা বাবু এই প্রাসাদেই থাকতেন। প্রাসাদের সামনে বাহারি ফুলের বাগান ছিল প্রাসাদের পশ্চিম দিকে খিড়কি দরজা পার হয়ে সান বাঁধানো একটি বিরাট পুকুর রয়েছে। এই পুকুরে শুধু জমিদার পরিবারই গোসল করত। প্রাসাদের ভেতরের এক পাশে ছিল জলসা ঘর। কলকাতা থেকে ভোলানাথ অপেরা এসে গান বাজনা করতো। পূর্ব দিকের দেউড়রি দুই পাশে ছয় জন করে বারো জন বরকন্দাজ থাকত। দেউড়রি পাশে ছিল মালখানা। এর কিছু দূরে ছিল মহাফেজখানা। প্রাসাদের পূর্বের দেউড়রি পার হয়ে সামনে আরেকটি বড় পুকুর আছে, সেখানে গোসল করত আমলা, পেয়াদা ও বরকন্দাজরা। এই পুকুরটি এখন বেদখল হয়ে গেছে। বকুলতলার পাশে খাজনা আদায়ের ঘর।
দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে রেন্ট রোল অ্যাক্টের বলে জমিদারিপ্রথা বিলুপ্ত হলে বিশাল অট্টালিকা, জমিজমা, মূল্যবান জিনিসপত্র ফেলে বিরুবাবু সপরিবার ভারতে চলে পরবর্তীকালে এই বাড়িটি সরকারের দখলে চলে আসে। তার ৫জন পুত্র ছিলেন। তারা হলেনঃ পরিমল, নির্মল, সুনীল, শ্যামল ও অমল। বিরুবাবুর ঘনিষ্ঠ সহচর বয়োবৃদ্ধ কালিপদ সরকার এখনো বীরকুৎসাতেই আছেন। জমিদারের ১টি হাতী ও ৪টি লালবর্ণের ঘোড়া ছিল। হাতীতে চড়ে তিনি জমিদারী দেখাশুনা করতেন। জমিদারের ১৭টি নায়েব খাজনা আদায় ও হিসাব রাখতেন। এই হাজার দুয়ারি রাজবাড়ি প্রতœতত্ত্ব বিভাগ তার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
যা এখন বীরকুৎসা তহসিল অফিস নামে পরিচিত। এর পাশের পূজা মন্ডপটিতে বসানো হয়েছে পোস্ট অফিস। বর্তমানে জমিদার বাড়ি ভৌত কাঠামো সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে রেন্ট রোল অ্যাক্টের বলে জমিদারিপ্রথা বিলুপ্ত হলে বিশাল অট্টালিকা, জমিজমা, মূল্যবান জিনিসপত্র ফেলে বিরুবাবু সপরিবার ভারতে চলে যান। বিরুবাবুর ঘনিষ্ঠ সহচর বয়োবৃদ্ধ কালিপদ সরকার এখনো বীরকুৎসাতেই আছেন।
স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ, এসব কক্ষে এখন সন্ধ্যার পর নেশার আড্ডা বসে, আর দিনের বেলায় বসে জুয়ার আসর। জমিদার বীরু বাবুর দাদা অবিনাশের নাম অনুসারে প্রাসাদের কাছে ১৯১৭ সালে বীরকৎসা অবিনাশ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। হাজার দুয়ারীর চার পাশসহ বিভিন্ন জায়গায় জমিদারদের ফেলে যাওয়া প্রায় ৩শ’ বিঘা জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিভিন্ন ভাবে দখল করে রেখেছে। বাকি জমি যে যেভাবে পেরেছে দখল করে নিয়েছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল জানান, এই হাজার দুয়ারি রাজবাড়ি প্রতœতত্ত্ব বিভাগ তার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। গত বছর ১৬ আগস্ট সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এসংক্রান্ত পরিপত্র জারি করেছে। দ্রুত জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে এর কোন চিহ্ন হয়তো থাকবে না। তখন বাড়িটি মানুষের মনে স্মৃতি হয়ে থাকবে।