gramerkagoj
শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ১৫ চৈত্র ১৪৩০
gramerkagoj
“মামা বাড়ির আবদার” অফারে ধরা খেলো যশোরের হাজারো গ্রাহক

❒ ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠান ই-বিপনী’র প্রতারণা

প্রকাশ : মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই , ২০২২, ০১:৩৪:৪৭ এ এম
উজ্জ্বল বিশ্বাস :
1658172922.jpg
কম মূল্যে মোটরসাইকেল দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ই-বিপণি নামে একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করেছে হাজারো গ্রাহকের সাথে। এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান যোতিকা রায় ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিঠুন কুমার রায়কে হন্যে হয়ে খুঁজছেন গ্রাহকরা। তারা গ্রাহকের প্রায় তিন কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছেন। তবে, কিছু গ্রাহক তাকে মোবাইল ফোনে পেলেও তাদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় কয়েকজন গ্রাহক আদারতে মামলা করেছেন। গ্রামের কাগজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-বিপণি লিমিটেড কোম্পানি বাংলাদেশ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিস এন্ড ফার্মস থেকে রেজিস্ট্রেশন নেয়। যার লাইসেন্স নম্বর ছিল সি-১৬৭০৯৮/২০২০। কোম্পানিতে যশোরের অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী গ্রামের অলঙ্গ রায়ের মেয়ে যোতিকা রায় চেয়ারম্যান ও তার স্বামী ফুলেরগাতি গ্রামের বৈদ্যনাথ রায়ের ছেলে মিঠুন কুমার রায় ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে ছিলেন। কোম্পানির সকল অর্ডার ও ডেলিভারি সিস্টেম পরিচালিত হতো ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে। কোম্পানির একটি ওয়েবসাইট ছিল বনরঢ়ড়হব.পড়স.নফ নামে, যা এখন বন্ধ। ২০২১ সালের ১৮ মার্চ যশোরের মোহাম্মদ শামরুল ইসলাম নামে এক গ্রাহককে ১৫০ সিসির পালসার মোটরসাইকেল দেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় কোম্পানির ডেলিভারি যাত্রা। তবে, ২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর যশোর সদর উপজেলার আমদাবাদ পিকআপ পয়েন্ট থেকে হুমায়ুন কবীর নামে এক গ্রাহককে ১৫০ সিসির বাজাজ পালসার ডেলিভারির পর আর কোনো মোটরসাইকেল ডেলিভারি দেয়নি এ কোম্পানি। কোম্পানির ডাটাবেজে হুমায়ুন কবীরের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২০৩।        ই-বিপণির অফার তৈরি, পিকআপ পয়েন্ট স্থাপন ও গ্রাহক তৈরির ম্যানেজমেন্টে ছিল যশোরের অর্জন কর্পোরেশন লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি। এ কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন মহিদুল ইসলাম, ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাসেল হাসান, ডিরেক্টর মোহাম্মদ রানা, মহিনুল ইসলাম কাজল ও খায়রুল ইসলাম। অর্জন কর্পোরেশনই মূলত ই-বিপণির সকল প্রকার অফার ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতো। এ কাজের জন্য তাদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার ভিত্তিতে তারা ই-বিপণিকে সফটওয়্যার পরিচালনাসহ অন্যান্য কাজের সহযোগিতায় ছিল।  তবে, ই-বিপণির বাজার ব্যবস্থাপনায় থাকা অর্জন কর্পোরেশন লিমিটেড অনেক আগেই তাদের চুক্তি বাতিল করেছে বলে জানান কর্মকর্তারা। তবে, অর্জন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।  এই কোম্পানিতে সর্বশেষ টাকা জমা হয় মাগুরার আড়পাড়ার ১৫১ ও ১৫২ নম্বর লিস্টে থাকা বিউটি বিশ্বাসের কাছ থেকে। তিনি ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুটো বাজাজ পালসার ১৫০ সিসি মোটরসাইকেলের জন্য টাকা জমা দেন। এরপর আর কোনো টাকা কোম্পানিতে জমা পড়েনি বলে তথ্য মিলেছে। এর আগেই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিঠুন কুমার রায় স্বপরিবারে আড়পাড়া থেকে পালিয়ে যান।টাকা গ্রহণ ও গাড়ি বিতরণের পিকআপ পয়েন্টের তালিকায় আড়পাড়া পিকআপ পয়েন্টে ছিলেন মোহাম্মদ সেলিম, মহেশপুরে জহিরুল ইসলাম জহির, কালীগঞ্জে রেজওয়ান চৌধুরী, যশোরের আমদাবাদে মহিনুল ইসলাম কাজল, যশোর শহরের জেস টাওয়ারে রানা হামিদ, নড়াইলে আল আমিন, ঝিনাইদহে মাসুদুর রহমান মাসুদ, হাটবারো বাজারে সোহাগ এবং চুড়ামনকাটিতে রাসেল হাসান। এই পয়েন্টগুলো থেকে মূলত গ্রাহকদের টাকা সংগ্রহ ও মোটরসাইকেল বিতরণ করা হতো। এসব পয়েন্ট থেকে টাকা সংগ্রহ করতেন ধুরন্ধর মিঠুন রায় ও তার নিজস্ব কর্মী বাহিনী। এই পয়েন্ট অনুমোদনের নামেও তিন লাখ টাকা জমা দিতে হতো কোম্পানির কাছে। যার বিনিময়ে পিকআপ পয়েন্টে প্রতিমাসে ২০ হাজার করে অফিস খরচ ও মোট লেনদেনের এক দশমিক পাঁচ ভাগ টাকা কমিশন দেয়া হতো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। মোটরসাইকেল  ডেলিভারি না পাওয়াদের কোম্পানির তালিকার ১৪১ ও ১৪২ নম্বরে আছেন যশোর শহরের এমকে রোডের আরিফুল ইসলাম শাওন। তিনি বলেন, তিনি ই-বিপণির কাছে ১১টি মোটরসাইকেলের অর্ডার দেন। এর মধ্যে ইয়ামাহা এফজেড ভার্সন থ্রিসহ বিভিন্ন মডেলের মোটরসাইকেলের জন্য ১৫ লাখ টাকা দেন ই-বিপণির কাছে। ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বরের দিকে তিনি এসব গাড়ির অর্ডার দেন। তবে, তিনি দু’টি ছাড়া বাকি নয়টি মোটরসাইকেল বা নগদ টাকার কোনোটি গত সাত মাসেও ফেরত পাননি বলে অভিযোগ করেন। তিনি আরও জানান, তার নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার করে এ টাকা জমা দেন। ১৫ লাখ জমা দিয়ে এখন পথে বসেছেন শাওন। তবে, ই-বিপণি ঢাকা থেকে পরিচালনা না করে মাগুরার আড়পাড়া থেকে পরিচালিত হতো। যার কারণে বিশ্বাসের জায়গাটা বেশি কাজ করেছে বলেই তিনিসহ আরও অনেকে টাকা দেন। প্রতিটি গাড়িতে তিনি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম অফারের কারণে এখানে টাকা বিনিয়োগ করেন বলে জানান তিনি। পেনডিং তালিকার ১৫০ নম্বরে রয়েছেন নিউ মার্কেট এলাকার জুম্মান হোসেন। তিনি একজন ফ্রিল্যান্সার। অনলাইনে ই-বিপণির ‘মামা বাড়ির আবদার’ নামে একটি অফার থেকে ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারিতে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার কবিরের  মাধ্যমে দু’টি গাড়ির অর্ডার করেন। একটি পেলেও গত সাত মাসে তার কাগজপত্র হাতে পাননি বলে অভিযোগ তার। তবে, বাকি গাড়ির জন্য বারবার তাগিদ দিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তিনি আরও বলেন, এ কোম্পানিকে ভার্চ্যুয়াল মানি জোগাড় ও ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ছিল যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের একটি কোম্পানি। তিনি তার কাছে মোট দু’ লাখ ৪৫ হাজার পাঁচশ’ টাকা দেন দু’টি মোটরসাইকেলের জন্য।                                                                                                                         অনলাইনে পেমেন্ট গেটওয়ে এসএসএল পেমেন্ট গেটওয়ের ২০টি ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা প্রদান করতো গ্রাহকরা। এছাড়াও অধিকাংশ গ্রাহক পিকআপ পয়েন্টের মাধ্যমে নগদই বেশি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের অফার ছিল ‘মামা বাড়ির আবদার’ নামে। মোটরসাইকেলের মোট মূল্যের ২৫ শতাংশ কম টাকা জমা নেয়া হতো এ কোম্পানিতে। ৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে অর্ডার দেয়া মোটরসাইকেল প্রদান করা হতো। তবে,গ্রাহকদের অভিযোগ ১০টি মোটরসাইকেলের অর্ডার করলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেয়া হতো মাত্র একটি থেকে দু’টি মোটরসাইকেল। বাকিগুলোর টাকা রেখে দিতেন মিথুন। এদিকে ই-বিপণির সোয়া ৪১ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যশোরের আদালতে একটি মামলা হয়। যশোর জেস টাওয়ারের সিএইচএল স্কুল অফ টেকনোলজির মালিক রানা হামিদ এ মামলা করেন। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মঞ্জুরুল ইসলাম অভিযোগটি গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার আদেশ দেন। এতে আসামি করা হয় মিঠুন কুমার রায় ও তার স্ত্রী যোতিকা রায়কে। মামলায় উল্লেখ করা হয়, আসামিরা ই-কমার্স ব্যবসায়ী। তারা ২৫ শতাংশ ছাড়ে মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোনসেট বিক্রি করতেন। প্রতিষ্ঠানের ঘোষণা ছিল, তাদের ই-কমার্স সাইটে টাকা জমা দিলে ২৫ শতাংশ ছাড়ের মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোনসেট ৬০ দিনের মধ্যে সরবরাহ করবেন। রানা হামিদসহ ১৭ জন ক্রেতা মোটরসাইকেল কেনার জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের ই-কমার্স সাইটে সোয়া ৪১ লাখ টাকা প্রদান করেন। এর মধ্যে রানা হামিদ ২৫ শতাংশ ছাড়ে একটি ইয়ামাহা আর-১৫ ভি-৪ মোটরসাইকেল কেনার জন্য ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৪শ’ টাকা দেন। ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর তিনি শর্ত অনুযায়ী টাকা পরিশোধ করেছিলেন। কিন্তু আসামিরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রানা হামিদকে মোটরসাইকেল সরবরাহ করেনি। বাকি ১৬ জন ক্রেতাকেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৩০টি মোটরসাইকেল সরবরাহ করা হয়নি। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা সর্বশেষ গত ২১ এপ্রিল আসামিদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা টাকা গ্রহণের কথা অস্বীকার করেন। মোটরসাইকেল অথবা টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তিনি আদালতে এ মামলা করেন।ই-বিপণির সিইও’র পদে থাকা রাসেল হাসান বলেন, তিনি মূলত কোম্পানির সিইও’র দায়িত্বে ছিলেন। যত টাকা তার এলাকা থেকে বা অন্যরা দিয়েছেন তার সব টাকাই কোম্পানির ঊর্ধ্বতনদের কাছে জমা দেয়া হয়। তিনি বলেন আজ তিনি দেনার পাহাড়ে আটকে গেছেন। যার জন্য দায়ী যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের একটি প্রতিষ্ঠান। তাকেসহ আরও কয়েকজনকে ডেকে ই-বিপণির সাথে ওই প্রতিষ্ঠান যুক্ত করে দেয় বলে তিনি অভিযোগ করেন। যশোরের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ওয়ালিদ বিন হাবিব বলেন, এটা গ্রাহকের সাথে প্রতারণা। কারণ তারা প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের পণ্য বুঝিয়ে দেয়নি। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা তার কাছে একাধিক অভিযোগ দিয়েছেন। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখছেন বলে জানান তিনি। এ ঘটনায় হওয়া একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই যশোরের পুলিশ পরিদর্শক একেএম ফশিউর রহমান বলেন, ই-বিপণি যে গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করেছে তার সত্যতা মিলেছে। মিথুন পলাতক রয়েছে এবং তাদের পরিচালিত অফিসও এখন বন্ধ।  খুব শিগগির তিনি আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।    

আরও খবর

🔝