gramerkagoj
মঙ্গলবার ● ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ৩ বৈশাখ ১৪৩১
gramerkagoj
মতামত
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ১০টি মিথ্যাচার এবং প্রকৃত তথ্য
প্রকাশ : সোমবার, ১ জানুয়ারি , ২০২৪, ১০:৪১:০০ পিএম , আপডেট : মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল , ২০২৪, ০৪:৫২:৪২ পিএম
বিপ্লব কুমার পাল:
GK_2024-01-01_6592ec6f34360.jpg

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে নানামূখী সমালোচনা হচ্ছে। যার বেশির ভাগই মিথ্যা এবং বিকৃত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। রিং টিরিং সাইকেল চালাই শিরোনামের সবচেয়ে আলোচিত এই ভিডিওটি ভারতের আসমের ধুবরি জেলার শিক্ষক প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও। আসামের বিভিন্ন স্কুলে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন যানবাহন সম্পর্কে পরিচিত করে তুলতে এই কবিতাটি পড়ানো হয় এবং ঐ অঞ্চলে এটি ‘ভঙ্গিমা গীতি’ হিসেবে পরিচিত। আর হাঁসের ডাক দিতে দিতে হাঁটা শিরোনামের ভিডিওটি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় গতবছরের অক্টোবর-নভেম্বরে শিক্ষক প্রশিক্ষণের। গণিত অলিম্পিয়াড প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ম্যানুয়াল অনুযায়ী এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিলো।

যে কোনো বিষয়ট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু মিথ্যা তথ্য বা অন্য দেশের অন্য বিষয়ের ভিডিও কেন আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম হিসেবে চালিয়ে দিতে হবে? সমালোচনা করার যুক্তি সঙ্গত কারণ না থাকলে সাধারণত এধরণের মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়। এই গুজব-বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আসলে কাদের লাভ? আমার সন্তান ভালো লেখাপড়া শেখার জন্য অন্যদের এতো দরদ কেন? কিছুটা মায়ের চেয়ে মাসির দরদের মতো। কিন্তু কেন? এই শিক্ষাক্রমের কারণে কোচিং ব্যবসা বন্ধ হবে, নোট বা গাইড বইয়ের ব্যবসাও বন্ধ হবে। এজন্য কী তাদের এতো মাথা ব্যথা? ভুলে গেলে চলবে না কোচিং আর গাইড বইয়ের ব্যবস্থা কিন্তু হাজার কোটি টাকার ওপরে।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আট শতাধিক বিশেষজ্ঞের অভিমত নেওয়া হয়েছে। সব কটি বইকে আমরা বলছি পরীক্ষামূলক সংস্করণ, আমরা মনে করিনি আর পরিশীলন-পরিমার্জন দরকার নেই, একবারে চূড়ান্ত। আমরা মনে করি, এ বইগুলো আরও পরিশীলন-পরিমার্জনের সুযোগ রয়েছে। সে জন্য সবার পরামর্শ গ্রহণ করছি।

তবুও নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে মিথ্যাচারে হচ্ছে। বিভিন্ন অভিযোগ তুলে অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা হচ্ছে। চলুন দেখে আসি কী কী অভিযোগ তোলা হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে। পাশাপাশি জেনে নেই সেসব মিথ্যাচারের প্রকৃত তথ্য।

প্রথমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে- ‘হঠাৎ করে কোনো গবেষণা ছাড়াই বিদেশি শিক্ষাক্রম অনুসারে দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে; এটি প্রণয়নের পূর্বে নীতিনির্ধারকেরা দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেননি’ এই অভিযোগটি কি সত্যি। আসুন জেনে নেই কীভাবে শিক্ষাক্রম চালু হলো?

এবারের শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনার পূর্বে ২০১৭ সাল থেকে শরু করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৬টি সরেজমিন গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষণাগুলোতে দেশের প্রেক্ষাপট, শিক্ষার্থীদের চাহিদা, পুরাতন শিক্ষাক্রমের কার্যকারিতা যাচাইসহ প্রায় ১০২টি দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে অভিযোজনের উপায় ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন সভা ও কর্মশালার মাধ্যমে প্রায় ১৫০ এর বেশি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ/ব্যক্তিবর্গের মতামত এবং সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাধারার মাঠ পর্যায়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ আটশ’র বেশি অংশীজনের সুপারিশ অনুযায়ী ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’ এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়। দেশের ৫টি স্বনামধন্য দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এনসিটিবি’র ওয়েব সাইটে উক্ত খসড়ার উপর মতামত সংগ্রহের জন্য জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করা হয় এবং তাদের মতামত পর্যালোচনার ভিত্তিতে খসড়া পরিমার্জন করা হয়।

জাতীয় সংসদের শিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্যদের কাছে খসড়া শিক্ষাক্রম রূপরেখা উপস্থাপন করে তাদের মতামত গ্রহণ করা হয়। এরপর খসড়া শিক্ষাক্রম রূপরেখাটি দেশের শিক্ষাক্রম উন্নয়নের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার জন্য তাঁর কাছে উপস্থাপন করা হয়। সেই আলোকে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’ চূড়ান্ত করা হয়। এরপর শিক্ষা বিষয়ক সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির যৌথ সভায় এই রূপরেখা অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ এর আলোকেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ উন্নয়ন ও অনুমোদন করা হয়। এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখন সামগ্রী (পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক সহায়িকা ও অন্যান্য উপকরণ) প্রস্তুত করা হয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ দেশের বিভিন্ন ক্যাটাগরির (যেমন সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি) ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক বছর ধরে পাইলটিং করা হয়। পাইলটিং এ প্রাপ্ত সুপারিশ অনুযায়ী পরিমার্জন করে সারাদেশে ২০২৩ সাল থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে প্রবর্তন করা হয়। প্রাক-প্রথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ধাপে ধাপে এই শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হবে।

সহজে বোঝা যায় হঠাৎ করে নতুন শিক্ষাক্রমটি প্রবর্তন করা হয়নি। দীর্ঘ ৪ বছর এটি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ধাপে ধাপে পরিবর্ধন ও পরিমার্জন হয়েছে। মূলত একটি বিশেষ গোষ্ঠী নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে মিথ্যাচার করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। শিক্ষাকে পণ্য করে যারা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে, নতুন শিক্ষাক্রম তাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে। সেকারণে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে গুজব ছড়িয়ে অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্তি করার অপচেষ্টা করছে।

আরেকটি অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেটি হলো- বিদেশি কারিকুলাম জোড়াতালি দিয়ে বানানো হয়েছে। অভিযোগটি কি সত্যি?

আমরা জানি, ব্রিটিশ কলোনিয়াল শিক্ষা ব্যবস্থা শুরুর পূর্বে এই জনপদের শিক্ষা মডেল ছিল এলাকাভিত্তিক, যা টোল, মক্তব, পাঠশালা নামে পরিচিত। এই মডেল সৃজনশীল গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী তৈরি থেকে শুরু করে সমস্যা সমাধানকারী সৃজনশীল মানুষ ও উদ্যোক্তা তৈরি করেছিল, যার ফলে বাংলা হয়েছিল পৃথিবীতে সমৃদ্ধ। এই শিক্ষাক্রম অতীত বাংলার শিক্ষা মডেলের সেই সবল দিকগুলোর সাথে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সাথে খাপ খাওয়ানোর বিষয়বস্তুগুলোর মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি দেশীয় সময়োপোযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছে। যা এই দেশের ঐতিহ্য ও স্বপ্নকে একই সাথে ধারন করেছে। সুতরাং এই শিক্ষাক্রম অন্য কোনো দেশের শিক্ষাক্রমকে অনুকরণ করে প্রণয়ন করা হয়নি। বরং এটা বাংলাদেশের নিজস্ব শিক্ষাক্রম।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে- ইংরেজি মাধ্যমের পড়ালেখা অনেক বেশি, নতুন শিক্ষাক্রমে কোনো পড়ালেখাই নেই।

বিশ্বব্যাপী ইংরেজী মাধ্যমে যে শিক্ষাক্রম চলমান রয়েছে (যেমন ক্যামব্রিজ, নর্থ অ্যামেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান ইত্যাদি) তা তাদের নিজেদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য পরিচালিত শিক্ষাক্রম থেকে ভিন্ন। নিজেদের দেশের শিক্ষাক্রম অনেক বেশি শিক্ষার্থী নির্ভর, অভিজ্ঞতাভিত্তিক এবং সৃজনশীল চর্চার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরির উপাদানে ভরপুর, যার ফলে এই দেশগুলো শিক্ষা প্রসার, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশও এই বিদেশি শিক্ষাক্রম দ্বারা পরিচালিত ভোক্তা তৈরির পরিবর্তে সৃজনশীল নাগরিক তৈরি নিশ্চিত করার জন্যই নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করেছে। কাজেই ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত শিক্ষাক্রমে বেশি পড়ালেখা থাকলেই যে তা সৃজনশীল মানুষ তৈরি করবে, তা সঠিক নয়।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে মিথ্যাচার ছড়ানো হচ্ছে যে, গণিত বইয়ে পর্যাপ্ত অনুশীলনের সুযোগ নেই।

গণিত বইটির সকল অভিজ্ঞতাই অনুশীলন নির্ভর, এর উপস্থাপন একটু ভিন্নভাবে করা হয়েছে। গণিতের বাস্তব প্রয়োগকে বিবেচনায় রেখে ব্যাখ্যামূলকভাবে এটি সাজানো হয়েছে। অভিজ্ঞতা চলাকালে বিভিন্ন কার্যক্রমের (একক কাজ, জোড়ায় কাজ, দলগত কাজ) মধ্য দিয়ে গণিতের তত্ত্ব ও সূত্র প্রয়োগ করে বিভিন্ন ধরনের গাণিতিক সমস্যা সমাধানের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে পুরাতন বইয়ের মতো অনুশীলনীতে প্রচুর গাণিতিক সমস্যা রাখা হয়নি। বরং গাণিতিক সমস্যা সমাধানে বিশেষ দক্ষতা অর্জনের জন্য গণিতে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিককে গুরুত্ব দিয়ে অনেক বিশ্লেষণাত্মক উদাহরণ ও কাজ সংযুক্ত করা হয়েছে; যা শিক্ষার্থীদের গণিত ভীতি কমাতে সাহায্য করবে এবং একইসাথে নিজে নিজে বুঝে তত্ত্ব ও সূত্র সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে সহায়তা করবে। ফলে গণিত মুখস্থ নয়, শিক্ষার্থী সত্যিকার অর্থে বুঝে গাণিতিক সমস্যা নিজেরাই তৈরি করতে এবং তার প্রয়োগ করে সমস্যা সমাধান করতে অভ্যস্থ হয়ে উঠবে।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আরেকটি অপপ্রচার চালানো হচ্ছে- শিল্পবিল্পবের এই যুগে অন্যান্য দেশ শিক্ষার্থীদের যখন রোবট বানানো শেখাচ্ছে, সেখানে নতুন শিক্ষাক্রমে কাগজ কাটাকাটি, গৃহস্থালির কাজ, রান্নাবান্না ইত্যাদি কাজ শিখিয়ে বাবুর্চি আর মিস্ত্রি বানানো হচ্ছে কেন? এসব গৃহস্থালির কাজ মানুষ স্বভাবজাতভাবে পরিবারেই শিখতে পারে, ঘরের কাজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?

নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি থেকেই গণিত, বিজ্ঞান ও ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে কোডিং, প্রোগ্রামিং এবং রোবট বানানোর কাজ শেখানো হচ্ছে। জীবন ও জীবিকা বিষয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পেশায় শিক্ষার্থীদের মৌলিক দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

পৃথিবীর সকল দেশেই ব্যক্তিগত পরিচর্যা, গৃহস্থালির কাজ, রান্নাবান্না ইত্যাদি সকল শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখানো হয়। রান্নার মাধ্যমে গণিতের অনুপাত ও পরিমাপ, বিজ্ঞানের রাসায়নিক বিক্রিয়া, স্বাস্থ্য-সুরক্ষার পুষ্টির ধারণা এবং দলগত আয়োজনের মধ্য দিয়ে সহযোগিতা, দায়িত্ববোধ ও দায়িত্ব বন্টনের দক্ষতাগুলো অর্জিত হয়। আমাদের দেশেও “গার্হস্থ্য বিজ্ঞান” বিষয়টিতে রান্না প্রচলিত ছিল, যা দৃষ্টিভঙ্গিজনিত কারণে শুধুমাত্র মেয়েরাই ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নির্বাচন করত, কিন্তু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই বিষয়গুলো প্রতিটিই অপরিহার্য, এগুলো হলো জীবন দক্ষতা। সুতরাং নতুন করে এগুলো আনা হয়নি, বরং অনেক বাছাই করে জীবনধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় কাজগুলোকে ছেলে-মেয়ে নির্বিশষে সকল শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামুলক করা হয়েছে।

আরেকটি অভিযোগ তোলা হয়েছে সেটি হলো- নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের ডিভাইসমুখী করে তুলছে বলে অভিভাবকগণ মনে করছেন, বিষয়টি সত্যি কিনা?

বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের ডিভাইস নির্ভরতা বেড়েছে কোভিডের সময়ে, যা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পূর্বের একটি বাস্তবতা। এর আরেকটি দিক হলো যুগের চাহিদা, প্রযুক্তির প্রসার ও ব্যবহার আজ অপরিহার্য যা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। এর যেমন ইতিবাচক দিক আছে, আবার নেতিবাচক দিকও আছে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন-শেখানো কার্যক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি অভিজ্ঞতানির্ভর হওয়ায় শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি চারপাশের পরিবেশের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিখবে, ফলে এটি ডিভাইস নির্ভরতা কমাবে। বরং ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বিষয়টির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ডিভাইস ও ইন্টারনেট ব্যবহারে নৈতিক বিষয় ও ঝুঁকিসমূহ জেনে ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জন করার মাধ্যমে দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারবে। নতুন শিক্ষাক্রমে ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। বিভিন্ন মাধ্যম যেমন- পাঠ্যপুস্তক, অন্যান্য পুস্তক, পত্রপত্রিকা, শিক্ষক, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তির নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে। শিক্ষার্থী এগুলোর এক বা একাধিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে কোনো পড়াশুনা নেই, পরীক্ষা নেই, শিক্ষার্থীরা কিছু শিখছে না’- অভিভাকদের এই উপলব্ধি কতোটা সত্যি?

আগে না বুঝেই শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করে লিখে প্রকাশ করতো, এটাই ছিল পড়াশুনার ধারণা। শিক্ষার্থীরা যেহেতু এখন শ্রেণিকক্ষে সক্রিয় হয়ে বুঝে পড়বে, ফলে তা অনেক বেশি মনে থাকবে এবং জীবনে প্রয়োগ করতে পারবে। দলগত কাজ করে আবার তা নিজেরাই উপস্থাপন করবে। শুধু জ্ঞান নয়, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও দক্ষতাও অর্জন করবে। আর মূল্যায়ন হবে প্রতিটি কাজের। এছাড়া, ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন এবং বার্ষিক মূল্যায়নও হবে। কাজেই মূল্যায়ন বা পরীক্ষা ঠিকই থাকছে, কিন্তু পরীক্ষার ভীতি থাকছে না। মূল্যায়নের মাধ্যমে উত্তীর্ণ হওয়া এবং না হওয়ার বিষয়টিও আছে; শুধু তাই নয়, পারদর্শিতার ৭টি স্কেলে তাদের রিপোর্ট কার্ডও দেওয়ার ব্যবস্থা আছে।

অভিযোগে বলা হচ্ছে- পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার ফলে উপরের শ্রেণিতে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাসমূহে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষাভীতি তৈরি হবে, এই অভিযোগ সত্যি কি সত্যি, আসুন প্রকৃত তথ্য জেনে নেই।

প্রথমে বলতে হবে, নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়নি। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে এধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এই শিক্ষাক্রমে প্রতিদিন শিক্ষার্থী যা শিখছে, তার মূল্যায়ন হচ্ছে। ফলে তার মধ্যে পরীক্ষা ভীতি দূর হয়ে মূল্যায়নও যে শিখনের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই ধারণা তৈরি হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি প্রক্রিয়া পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেখানে শিক্ষার্থীর মুখস্থ নির্ভর পরীক্ষার পরিবর্তে শিক্ষার্থীর প্রবণতা, ভাষাদক্ষতা, পূর্বের পারদর্শীতার রেকর্ড প্রভৃতির ভিত্তিতে ভর্তি নেওয়া হবে। ফলে ২০২৭ সালের পর নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা নতুন পদ্ধতিতেই উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে।

অভিযোগ তোলা হয়েছে- শিক্ষার্থীদের ব্যাকরণ পড়ানো হয় না, লেখালেখির সুযোগ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ফলে বানান, ব্যাকরণ ইত্যাদি শিখছে না। এই ধরণের অভিযোগের সত্যতা কতটুকু?

যেকোনো সময়ের চেয়ে শিক্ষার্থীদের এখন বেশি লিখতে হচ্ছে, কারণ প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি অভিজ্ঞতায় তাদের বিভিন্নভাবে প্রায়োগিক লেখার সুযোগ রাখা হয়েছে। তাই শিক্ষার্থীকে কোনো পাঠ্যপুস্তক বা নোট গাইড থেকে নয়, বরং নিজে থেকেই নিজের ভাষায় লেখতে হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীকে এখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের প্রয়োজনে বানান ও ব্যাকরণ শিখতে হচ্ছে। মূল টেক্সটের সাথে সাথে ব্যাকরণের অংশটুকুও পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখা হয়েছে। ব্যাকরণকে প্রয়োগমুখী করার ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাকরণ শেখাও সহজ হয়েছে।

ব্যাবহারিক কাজের জন্য প্রচুর উপকরণ প্রয়োজন হওয়ায়, নতুন শিক্ষাক্রমে অভিভাবকদের শিক্ষা ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে কিনা?

ব্যাবহারিক কাজের জন্য দামি উপকরণ, চাকচিক্য বা সৌর্ন্দয এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং স্থানীয়, সহজলভ্য ও পুনঃব্যবহারযোগ্য কাগজ ও উপকরণ ব্যবহারের নির্দেশনা বার বার দেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন নিয়মিত কার্যক্রমনির্ভর হওয়ায় নোট বই কিংবা কোচিংয়ের খরচ কমে যাবে। এসব কাজের ক্ষেত্রে যে ধরনের উপকরণ প্রয়োজন হচ্ছে ,তার অধিকাংশই বিনামূল্যের অথবা স্বল্পমূল্যের। এছাড়াও উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুনঃব্যবহারকে (রিসাইকেল) উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন- রঙ্গিন পোস্টারের পরিবর্তে বাড়িতে থাকা পুরোনো ক্যালেন্ডারের পাতা, সাধারণ কাগজ জোড়া দিয়ে বানানো শিট ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া, অনেক উপকরণ বিনামূল্যে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকেই পাওয়া সম্ভব। তাই অভিভাবকদের খরচ বেড়ে গেছে – এই অভিযোগটি মোটেও সঠিক নয়।

আমাদের নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য যোগ্য শিক্ষক ও অবকাঠামো আছে কিনা এটি নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

নতুন এই শিক্ষাক্রম অনেক নমনীয়, তাই বিদ্যমান অবকাঠামোতে এর বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। বাস্তবায়নের জন্য পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছার আগেই সারা দেশের প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের অনলাইন এবং সরাসরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ভিডিও টিউটোরিয়াল এবং বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য অনলাইন মেন্টরিং গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশে প্রথম। দ্বিতীয় পর্যায়েও সারাদেশে সকল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। শিক্ষকদের আরও প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তোলার ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। হাতেকলমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চায় পরিবর্তন আসবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের কার্যক্রম গত একদশক ধরে ব্যাপকহারে চলছে। বিষয় ও শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক নিয়োগ, ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধরনের প্রস্তুতি চলছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের মূল সারমর্ম হচ্ছে—সংবেদনশীল, জবাবদিহিমূলক, একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞান, যোগ্যতা, মূল্যবোধ ও দক্ষতা বাড়াতে জাতীয় শিক্ষাক্রমের মূল ভিত্তি ঠিক করা হয় জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখায়। যোগ্যতা নির্ধারণে শিক্ষার্থীদের প্রেরণা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করা হয়েছে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

 

 

আরও খবর

🔝