gramerkagoj
বৃহস্পতিবার ● ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ৫ বৈশাখ ১৪৩১
gramerkagoj

❒ আসন্ন নির্বাচন ইস্যূতে অস্ত্র উদ্ধারে মাঠে র‌্যাব ও পুলিশ

যশোরে আবিস্কৃত ৪ কারখানার বিকিকিনির অস্ত্রগুলো কোথায়

❒ নজরদারিতে জামিনে থাকা দাগি অপরাধীরা

প্রকাশ : বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারি , ২০২৪, ০৯:৩৯:০০ পিএম , আপডেট : মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল , ২০২৪, ১০:৪৩:০৫ পিএম
দেওয়ান মোর্শেদ আলম:
GK_2024-01-04_6596d1cb8e911.jpg

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ৫ দিন বাকি। পেশি শক্তি ও অস্ত্রবাজ রুখতে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যশোরে মাঠ চষছে র‌্যাব ও পুলিশ। নজরদারিতে জামিনে থাকা দাগি অপরাধী ও কিছু উঠতি রাজনীতিক। একই সাথে বিভিন্ন প্রার্থীর নির্বাচনী সভাতেও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে অবৈধ অস্ত্রের খোঁজে।
এছাড়া বিগত বছরে যশোর শহর ও শহরতলীতে আবিস্কৃত হওয়া ৪টি অবৈধ অস্ত্র কারখানার বিষয়েও নতুন করে আলোচনায় এসেছে। পুলিশের অনুসন্ধানে সন্ধান মেলা ওই ৪টি অস্ত্র কারখানার কারিগর ও কারখানা মালিকের বিক্রি করা অস্ত্রগুলো এখন কোথায়? এসব অস্ত্র নির্বাচনী সহিংসতায় ব্যবহার হতে পারে শঙ্কায় জোরালো খোঁজ খবর নেয়ার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। দাবি উঠেছে অস্ত্রগুলো কোথায়, কার বা কাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল এসবের উত্তর খোঁজার।
যদিও নির্বাচন ইস্যূতে বিগত কয়েকমাস থেকে গতকাল ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত র‌্যাব ও পুলিশি অভিযানে বিগত কয়েকমাসে ডজন দেড়েক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। আটক হয়েছে একডজন দাগি আসামি, যারা ডজন মামলার আসামি।
২০২২ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে যশোর জেলা গোয়েন্দা শাখা ডিবির একটি চৌকস টিম রাঙামাটি গ্যারেজ এলাকায় একটি অস্ত্র তৈরির কারখানার খোঁজ পান। ওখানে রীতিমত অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম যোগাড় করে অস্ত্র তৈরি হচ্ছিল। নিউ বিসমিল্লাহ ইঞ্জিয়ারিংয়ের সাইনবোর্ডের অন্তরালে চলচিল ওই ভয়ানক কারবার। অভিযান চালিয়ে হাতে নাতে আটক হয় যশোর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের আহম্মদ আলীর ছেলে ওই মালিক আব্দুল কুদ্দুস, একই গ্রামের ফারুক হোসেনের ছেলে সুমন হোসেন এবং শহরের বেজপাড়া এলাকার এলাহী বক্সের ছেলে আজিজুল ইসলামকে। ওই ওয়ার্কসপের ভেতর থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও তৈরির সরঞ্জামাদিতে প্রমাণ দেয় চক্রটি অত্যাধুনিক সব অস্ত্র তৈরি করছে আর সরবরাহ করছে। উদ্ধার হয় দু’টি দেশি তৈরি ওয়ান সুটার গান, যাতে ট্রিগার ও ফায়ার পিন সংযুক্ত হাতলসহ দৈঘ্য ৮ ইঞ্জি ২ সুতা, ৩ টি ৭.৬৫ পিস্তলের রিকয়েলিং স্প্রিং ও ব্যারেল সংযুক্ত স্লাইডার, যার প্রত্যেকটিতে খোদাই করে মেড ইন ইউপি ৭.৬৫ লেখা আছে। ৩টি ৭.৬৫ বডি ও ৩টি হাতল। ৮টি ৭.৬৫ পিস্তলের অসম্পূর্ণ ম্যাগজিন। ১টি গ্রান্ডিং মেশিন। পিস্তলের গ্রিপ তৈরির ফাইবার সাতটি। পিস্তলের সেপ্টি লক একটি, ৪টি পিস্তলের তৈরি চ্যানেল। ৭ টি স্প্রিং। ৩টি হেমার। ২টি ট্রিগার। ৯টি পেন্সিল পলিশ। ২৫টি অক্ষর খোদাই করা পাঞ্চ। ৭টি বড় স্প্রিং। ৫ রাউন্ড পিস্তলের গুলি ও ১টি ড্রিল মেশিন উদ্ধার করা হয়।
এর ১০ দিন পরে ২৩ অক্টোবর রাতে যশোরে চাঁচড়া ভাতুড়িয়া এলাকায় আরও একটি অস্ত্র কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। অস্ত্রসহ ইকবাল হোসেন নামে এক কারিগরও আটক হয়। সে চাচঁড়া ভাতুড়িয়া দাড়িপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। পূর্বপাড়া থেকে ইকবাল হোসেনকে একটি ওয়ান শুটারগানসহ আটক করা হলে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে কারখানার তথ্য জানায়। চাঁচড়ার মধ্যপাড়া মকছেদের পুকুরের পাশ থেকে মাটি খুঁড়ে আরও একটি ওয়ান শুটারগান উদ্ধার হয়। এরপর চাঁচড়া ভাতুড়িয়ার দাড়িপাড়ায় তার বাড়ির খাটের নিচ থেকে দুটি ওয়ান শুটারগানের গ্রিপ, দু’টি স্টিলের পাত, একটি ব্যারেল, ৪টি পাইপ, একটি বড় ব্যারেল পাইপ, দুটি লোহার ট্রিগারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এতে করে গোয়েন্দা শাখা নিশ্চিত হয় এই ইকবার একজন প্রশিক্ষিত অস্ত্র কারিগর এবং সে কারখানা চালায়।
একে একে দুটি কারখনার সন্ধান মেলাতে ও অস্ত্র উদ্ধারে আরো বিব্রত হয়ে পড়ে গোয়েন্দা শাখাসহ আরো কয়েকটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। শঙ্কা বাড়তে থাকে ওই কারাখানার তৈরি অস্ত্র এর আগে আরো অনেকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
এরপর গত বছরের ২৭ মার্চ রাতে যশোরের আলোচিত শংকরপুর এলাকায় সন্ধান মেলে আরো একটি অস্ত্র তৈরির কারখানা। এর ৫ মাস আগে শহরের রাঙ্গামাটি গ্যারেজ এলাকায় আবিস্কার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানা ও আটক হওয়া কথিত ওই কারখানা মালিকের সূত্র ধরে সন্ধান মেলে এই নয়া কারখানার। উদ্ধার হয় রিভলবার, ৪ রাউন্ড গুলি ও বিপুল পরিমান অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম। আটক করা হয় অস্ত্র কারিগর ও কারখানা মালিক শাহাদত হোসেনকে (৪০)।
এর আগে ৩ বছর আগে ২০১৯ সালে যশেরের ভাতুড়িয়ায় প্রথম অবৈধ কারখানার সন্ধান পায় পুলিশ। এসময় ওই কারখানায় মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করা হয়। আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি, ম্যাগাজিন, পিস্তল তৈরির সরঞ্জামসহ আটক করা হয় কারিগরসহ ৩ জনকে। এরা হচ্ছে যশোর সদর উপজেলার ভাতুড়িয়া দাড়িপাড়া গ্রামের আব্দুল গফুরের ছেলে অস্ত্র কারিগর কামরুল ইসলাম (৫০), কামরুলের স্ত্রী রাবেয়া সুলতানা (৩৫) ও ভাতুড়িয়া পশ্চিমপাড়া এলাকার নূর হোসেনের ছেলে আবুল বাশার (৪০)। আটক কামরুলের বাড়িতে এই অস্ত্র তৈরির কারখানার অবস্থান ছিল।
এ নিয়ে যশোর শহর ও শহরতলীতে ৪টি অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারাখানার সন্ধান মেলে। আটকের আগের বিভিন্ন সময়ে ওই কারখানায় কারিগররা ওয়ার্ডার নিয়ে হয়তো বড় কোনো চালান কেনো বিশেষ এলাকায় বা চক্রের কাছেও বিক্রি করেছে এমন ধারণা করে আসছিল পুলিশ। যশোরাঞ্চলের অনেকের কাছেই ওই ৪ কারখানার অস্ত্র থাকরে পারে। এই সন্দেহ ও ধারনা থেকে ডিবি পুলিশ জোরালো তদন্ত ও অনুসন্ধান অব্যাহত রাখে।
এদিকে সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা কোনো চক্রের হাতে ওই সব কারখানার বিক্রি করা অস্ত্র থাকলে থাকতে পারে এমন সন্দেহ স্থানীয় সাধারণ জনগনের মধ্যে।
সূত্রের দাবি, নির্বাচনী সভা বা মিছিলে অনেক দাগি লোকজন জমায়েত হচ্ছে। আর কারখানাগুলো ছিল যশোরেই। অস্ত্র কারিগর ও কারখানা মালিকদের বাড়িও যশোরে। পুলিশ কারখানা গুড়িয়ে দিলেও আগে বিকিকিনি করা অস্ত্রগুলো কোথায় এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সচেতন মহলে। যশোরের উঠতি রাজনৈতিক অনেক নেতার দখলে ওই কারখানাগুলোর অস্ত্র থাকতে পারে এমন সন্দেহ করা হচ্ছিল চলমান অভিযানের সময়। যে কারণে আসন্ন নির্বাচনে বিভিন্ন প্রার্থীর সভা মিছিলে যোগ দেয়া উঠতিদের দিকে গোয়েন্দা নজরদারি রাখতে হবে। আবার যারা নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দিয়েছে, তাদের দখলেও অস্ত্র থাকতে পারে। এসব খতিয়ে দেখা দরকার।
এদিকে, গোয়েন্দা শাখার একট সূত্র জানিয়েছে, জেলা গোয়েন্দা শাখা ডিবি আসন্ন নির্বাচন ইসূতে ইতোমধ্যে অস্ত্র উদ্ধারে নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে যশোরাঞ্চলে। জেলাব্যাপি জোরালো অভিযান শুরু করেছে। জামিনে আসা দাগি আসামিদের টার্গেট করছে। তারা অস্ত্র দখলে রাখতে পারে, আবার রাজনৈতিক সেল্টারে থাকা উঠতি স্থানীয় রাজনীতিক ও উঠতি দুর্বৃত্তদের তালিকায় রাখা হয়েছে। গত কয়েক মাসে ডিবি ও থানা পুলিশ ও র‌্যাব দেড় ডজন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। আটক করেছে পিচ্ছি রাজা, নাসির উদ্দিন, ইমরুল হাসান ইমরান, কাজী তোফায়েল আহম্মেদ অভিসহ ডজন খানেক দাগিকে। আটককৃতদের কয়েকজন কমপক্ষে এক ডজন করে মামলার আসামি। নির্বাচন ইস্যুতে পরিচালিত অভিযানে র‌্যাব ৩ জানুয়ারি যশোর সিটি কলেজপাড়া থেকে আটক করে ঝিকরগাছা কাটাখালির ইমরুল হাসান ইমরান (২১) ও কৃষ্ণনগরের কাজী তোফায়েল আহম্মেদ অভিকে। তাদের কাছ থেকে ১টি ওয়ানশুটারগান ও ১ টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।
তবে যশোরের ৪টি কারখানার অস্ত্র এখনও যশোরের বিভিন্ন বিতর্কিত ব্যক্তির কাছে থাকতে পারে দাবি করে চলমান অভিযান আরো জোরদার করার আহবান জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। যশোরের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী আটকে বিকল্প নেই বলেও দাবি তাদের।
এ ব্যাপারে ডিবির ওসি রুপন কুমার সরকার জানিয়েছেন, সন্ধান পাওয়া ৪টি অস্ত্র কারখানা ও আটককৃতদের নিয়ে এখনও অনুসন্ধান চলছে। ওই কারখানায় কাদের চলাচল ছিল, কোথায় বিক্রির উদ্দেশ্যে এ অস্ত্র বানানো হয়েছিল, আগে কারা কারা ওখান থেকে অস্ত্র কিনেছে এসব নিয়ে কাজ চলছে। যশোরাঞ্চলে অনেক দাগি বা চক্রের কাছে অস্ত্র চলে যেতে পারে সে প্রশ্নে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান এগুচ্ছে।
যশোর কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা ছাড়াও পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। এছাড়া নতুন করে অস্ত্রসহ আরো কয়েক অপরাধী আটক হয়েছে। যশোরে অস্ত্রবাজ চাঁদাবাজসহ কোনো অপরাধীর ছাড় নেই।
এ ব্যাপারে র‌্যাব ৬ সিপিসি যশোরের কোম্পানি কমান্ডার মেজর সাকিব হোসেন জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলমান রয়েছে। কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও সন্ত্রাসী আটক হয়েছে। সর্বশেষ ৩ জানুয়ারি উদ্ধার হয়েছে আগ্নোয়াস্ত্র ও সন্ত্রাসী আটক হয়েছে। এর আগে চাঁচড়ার একটি অভিযানে অস্ত্র উদ্ধারে গিয়ে অস্ত্র সংক্রান্তে অনেক তথ্য মিলেছে। সেই তথ্যে অনেককে খোঁজা হচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলমান থাকবে।

আরও খবর

🔝